রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩
মিসরের সেনা অভ্যুত্থান ও তুরস্কের শিক্ষা : আনোয়ার ইব্রাহিম
কেউ এটাকে বলছেন রাজনৈতিক ইসলামের ইতি ঘটা। অন্যরা বলছেন জটিল সময় থেকে উত্তরণ। আবার অনেকে সংশয়ে আছেন এটিকে সামরিক অভ্যুত্থান বলবেন কি না। প্রশ্ন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গণতন্ত্রের প্রবক্তারা সেনা অভ্যুত্থানকে কেন সেনা অভ্যুত্থান বলতে পারছে না বা চাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য জার্মানি তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো মন্তব্য করেছে এই বলে যে, মিসরে যা ঘটেছে তা দেশটির গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় ধরনের বিপত্তি। পশ্চিমের বাকি দেশগুলো শুধু সংযত থাকা এবং সহিংসতা এড়িয়ে চলার কথা বলে তাদের কপট অবস্থানকে আড়াল করতে চাইছে। তারা এটিকে অভ্যুত্থান বলতে পারছে না, পারছে না নিন্দা করতে, গণতন্ত্রের ব্যাপারে দ্বিমুখী নীতি প্রসঙ্গেও পারছে না কিছু বলতে।
তিউনিসিয়া নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের এ কাজকে গর্হিত অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে, এটি গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে আর তা উসকে দেবে চরমপন্থাকে।
গত ৫ জুলাই ইস্তাম্বুলে দেয়া এক ভাষণে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান এর নিন্দা করে বলেছেন, ‘কার বিরুদ্ধে কোথায় হয়েছে সেটি কোনো কথা নয়, সেনা অভ্যুত্থান বিপর্যয়কর, অমানবিক এবং জনগণ, জাতীয় আকাক্ষা ও গণতন্ত্রের বিরোধী।’ এই নিরাবেগ অভিযুক্তকরণের পর এরদোগান শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ববোধের ব্যাপারে ঝাঁকুনিই দেননি, একই সাথে তুরস্কের ইতিহাসের শিক্ষার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। অতীতের শিক্ষার কথা উল্লেখ করে এরদোগান বলেছেন, গণতন্ত্র হরণকারী সামরিক অভ্যুত্থানের যে নির্মম অভিজ্ঞতা তুরস্কের হয়েছে তা থেকে মিসর এখন শিক্ষা নিয়ে নতুন আশাবাদী পথের সন্ধান করতে পারে।
সবারই এখন প্রেসিডেন্ট মুরসি ও তার সমর্থকদের মুক্তির দাবি জানানো উচিত। আইনানুগ দায়িত্বে প্রেসিডেন্ট মুরসির পুনর্বহাল করার দাবি জোরালো করা উচিত। পুনর্বহালের পর মুরসির উচিত হবে কালবিলম্ব না করে সব পক্ষকে নিয়ে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা। মিসরের নবসূচিত সাংবিধানিক গণতন্ত্র খাদে পড়ে এখন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান করার মতো ‘উইন্ডো ড্রেসিং’-এ সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করার বাস্তবতা পাল্টে যাবে না। কেউ কেউ ৩০ জুনের সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে যুক্তি দেখান যে, ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারির হোসনি মোবারককে উৎখাতের বিপ্লবটিও তো ছিল সেনাসমর্থিত; কিন্তু বাস্তবে এ যুক্তি কোনোভাবেই ধোপে টেকে না। ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবটি ছিল তিন দশক ধরে জোর করে ক্ষমতায় থাকা এক স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করা আর মুরসির বিষয়টি হলো এক বছর আগে যিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের ক্ষমতায় এসেছেন তাকে উৎখাত করা। এ দু’টি বিষয় কোনোভাবেই এক হতে পারে না। এর মধ্যে আরো বৈপরীত্য এই যে, একজন ক্ষমতায় ছিলেন সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে আর অন্যজন ক্ষমতায় এসেছেন জনগণের ভোটের মাধ্যমে, যাকে জোর করে সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে। পশ্চিমা নীরবতা মিসরের সেনাবাহিনী যখন প্রেসিডেন্ট মুরসিকে আলটিমেটাম দেয় তখন পশ্চিমারা নীরব থেকে প্রকারান্তরে এটাকে সমর্থন জোগায়। এটি অপরাধকে গোপন করার মাধ্যমে বাস্তব বিষয়টি আড়াল করা। রাজনৈতিক ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সাথে করা দ্বিমুখী আচরণ নিয়ে বিতর্ক ওঠার পরও তারা সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা করতে পারেনি।
কোনো কোনো বিশ্লেষক বলতে চেয়েছেন, ইসলামপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যকার সঙ্ঘাত প্রেসিডেন্ট মুরসির পতনের কারণ। মিসরীয়রা তালেবান ধরনের সরকার চায়নি। এ ধরনের এ যুক্তির মধ্যে সারবত্তা একেবারেই কম। একটি ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এ যুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মুরসির পতন ঘটেনি, সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। অধিকন্তু যদিও মুরসির একনায়কসুলভ মনে হতে পারে এমন কিছু প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি জারির ঘটনা ছিল; কিন্তু তালেবানদের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডকে একইভাবে দেখানোকে অজ্ঞতা এবং ইসলাম বিদ্বেষপ্রসূত মনোভঙ্গি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
সত্যের কাছাকাছি বাস্তবতাটি হলো এই যে, মোবারক আমলের নিযুক্ত ব্যক্তিরা বিপ্লবের অব্যবহিত পর না হলেও মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্ষমতার ওপর তাদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বিস্তার করে বসে। এটা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে প্রতিবিপ্লবের জন্য এ শক্তিটি তখন থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে, যাতে তারা নিজেদের হারানো সোনালি দিনগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। দেখা গেছে, সেনা অভ্যুত্থানের পর সব মুখ্য পদে নিয়োগ দিয়েছে সেনাবাহিনী। এমন সব লোককে নিয়োগ করা হয়েছে যারা মিসরে অতীতের শাসন ফিরিয়ে আনার প্রতি অনাগ্রহী হবেন না। আর যারা মোবারকের অনুগামীদের বিদায় করা উচিত বলে মনে করে তাদের হিমঘরে পাঠাবে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষার বিষয়টি এখানে অনেক বড়। তুরস্কের সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের সামরিক বাহিনী তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ফিরে পেতে একের পর এক অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টার কথা মনে করিয়ে দেয়। তুরস্কের জনগণ কখনো রুপার বাটিতে করে গণতন্ত্রকে উপহার হিসেবে পায়নি। আজ আমরা মিসরে যেটি দেখছি সেটিই প্রত্যক্ষ করেছি তুরস্কে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সেখানে তুর্কি জনগণকে এর চেয়ে আরো কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। মুক্তমত, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে যারা ভালোবেসেছেন তারা রক্ত, ঘাম ও অশ্রুর বিনিময়ে সরকারে কে যাবে বা থাকবে তা নির্ধারণ না করে সেনাবাহিনী যেন কেবল জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বের মধ্যে নিজেদের সীমিত রাখেন তার জন্য লড়াই করে গেছেন। ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার বিষয়টি যেন কেবলই জনগণ ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারে সেটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন তুর্কি জনগণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতিহাসের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে আমরা কোনোভাবেই অসাংবিধানিক ও অনৈতিক অভ্যুত্থানের পক্ষ নিতে পারি না। আমরা আমাদের কর্তব্যের অংশটুকু পালন করি, যাতে দেখতে পাই মিসরের জনগণ তাদের ২৫ জানুয়ারির মহান বিপ্লবের অর্জনকে আবার ফিরে পেয়েছে।
এ জন্য অবশ্যই অনেক মূল্য দিতে হবে; কিন্তু সেনাশাসনের জন্য যে মূল্য দিতে হবে তার কষ্ট এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। প্রধানমন্ত্রী এরদোগান এটাকে এভাবে বলেছেন, ‘প্রতিটি সেনা অভ্যুত্থান তুরস্কের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তুরস্কের সম্পদ এবং লক্ষ্যের পথে অর্জিত অগ্রগতির ক্ষতি ঘটিয়েছে। দেশ, জাতি বিশেষত তরুণসমাজকে এ জন্য অনেক চড়া মূল্য গুনতে হয়েছে।’ মিসরীয়দেরও ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এখন তাদের আরো বেশি মূল্য দিতে হবে তা রক্ষার জন্য। কায়রোর রাবা আল আদউইয়া মসজিদের চার দিকে মুরসি সমর্থক এবং ব্রাদারহুড সদস্যদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালিয়ে ১০০ জনকে মৃত্যু ঘটানো মিসরীয় জনগণের জন্য অবর্ণনীয় ট্র্যাজিক ঘটনা। এর মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ও অবৈধ অন্তর্র্বতী সরকার তাদের হাতকে রক্তরঞ্জিত করেছে। এর দায় থেকে অবশ্যই তাদের রেহাই পাওয়া উচিত নয়। নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা চালানোর অবশ্যই নিন্দা জানানো উচিত সবার।
মুরসি প্রশাসনের অদক্ষতা ও সবাইকে ধারণ করতে না পারার সমালোচনা এবং সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ দেখানোর মতো বিশেষ পরিস্থিতি বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসবকে অভ্যুত্থানের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টার অবশ্যই নিন্দা জানানো উচিত। অধিকন্তু নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি জানা যায় যে, বিদেশী ও আঞ্চলিক অর্থসহায়তা দিয়ে রাস্তায় মুরসিবিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে। সে যাই হোক, গণবিক্ষোভ কোনোভাবেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য কোনো যুক্তি হতে পারে না। রাস্তায় বিক্ষোভের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ঘটনা ঘটতে পারে। আর এটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে পারে সরকার; কিন্তু সেনাবাহিনী রাস্তায় বিক্ষোভের জন্য নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করবে, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মিসরে এরপর কী? সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা বা বিরোধ অবসানের জন্য যে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে তা অন্তঃসারশূন্য কথামালা ছাড়া আর কিছু নয়। ঐক্য ও সংহতির আহ্বান জানানো এক কথা; কিন্তু এর উদ্দেশ্য যদি হয় ফাঁপা আওয়াজ দেয়া তখন তা থেকে কোনো ফল পাওয়া যায় না। সমঝোতা ঐক্য সংহতি প্রতিষ্ঠা কোনো সময় অবৈধ কোনো পক্ষকে দিয়ে সম্ভব হয় না। আর কারো মাথায় অস্ত্র তাক করে তাকে মীমাংসায় বাধ্য করা যায় না।
আমি পৃথিবীর অন্য সব ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রপ্রেমিক শক্তির পাশাপাশি পশ্চিমের কাছে বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সঠিক ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানাতে চাই। শত শত কোটি ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য মিসরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য দেয়া হয়েছে, সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করার জন্য এটি হতে পারে না। তাদের অবশ্যই প্রেসিডেন্ট মুরসি ও তার সমর্থকদের আশু মুক্তি ও মুরসিকে আইনসঙ্গত স্বপদে বহাল করার দাবি করা উচিত। পুনর্বহাল হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট মুরসির উচিত হবে সব পক্ষকে নিয়ে মিসরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নে সংলাপের আয়োজন করা। মিসরে যা করা হয়েছে তা কোনোভাবেই বিপ্লবের ব্যর্থতা নয়। এটি আরব জাগরণকে শীতের কাঁপুনিতে রূপান্তর করার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের খাদ বানানোর প্রচেষ্টা। প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হবে, এমন আশা করা যায় না। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতদের তাদের কর্তব্য শেষ করতে দেয়া উচিত। অথবা ন্যূনপক্ষে জনগণকে তাদের ম্যান্ডেট জানানোর জন্য নির্বাচনের নতুন সুযোগ করে দেয়া উচিত। যত দিন পর্যন্ত শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসন উচ্চকিত থাকবে তত দিন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যেমন অযৌক্তিক তেমনিভাবে এর পেছনে অন্য কোনো আইনি যুক্তিও দাঁড় করানোর অবকাশ নেই। মিসরের জনগণকে ছয় দশকের সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত কামড়ে লড়াইয়ে থাকতে হবে, যাতে তারা গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ পেতে পারে।
অসাংবিধানিক ও অনৈতিক সামরিক অভ্যুত্থানকে কোনোভাইে সমর্থন করার সুযোগ নেই। আমাদের ইতিহাসের সঠিক প্রান্তে অবস্থান নিতে হবে। আসুন আমরা আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করি, যাতে দেখতে পাই মিসরের ২৫ জানুয়ারির গৌরবদীপ্ত মহান বিপ্লবের অর্জন তারা আবার ফিরে পেয়েছে।
আনোয়ার ইব্রাহিম বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিরোধী দলের নেতা এবং সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। তার নেতৃত্বাধীন মালয়েশিয়ার বিরোধী জোট পিপলস ফ্রন্ট বিগত নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ ভোট পেলেও আসন কম পাওয়ায় এখন বিরোধী দলে রয়েছে। মিসরের অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে তার আলোচিত লেখাটি আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন ‘নয়া দিগন্তের’ ডেপুটি এডিটর মাসুমুর রহমান খলিলী।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)