বুধবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
দুই দলীয় অকার্যকর পদ্ধতির শিকার বাংলাদেশ: দি ইকোনমিস্ট
নতুন বার্তা :
কয়েক মাসে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ, বাংলাদেশ আবারও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রাজধানী ঢাকায় তার পার্টি অফিসে অবরুদ্ধ। তার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশব্যাপী সড়ক, রেল আর নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনে নিষেধাজ্ঞাই ছিল এ অস্থিরতার সূত্রপাত। সর্বশেষ ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের বদৌলতে সহজেই পুনঃনির্বাচিত হয়। চলমান আন্দোলনে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে। বেশির ভাগ বিএনপি নেতা জেলে, নির্বাসনে বা আত্মগোপন করে আছেন। তারা বিভিন্ন অপরাধ মামলার মুখোমুখি যা পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে পারে।
লন্ডনের বিখ্যাত দি ইকোনোমিস্ট পত্রিকাটির ২ ফেব্রয়ারি অনলাইন ভার্সনে ‘ডযু ইধহমষধফবংয’ং ঢ়ড়ষরঃরপং ধৎব নৎড়শবহ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ সঙ্কটপূর্ণ এক স্থানে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। সরকার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অবরোধের পাশাপাশি তিনি ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনের হরতালের ডাক দেন। কেন বাংলাদেশের রাজনীতি এ বিশৃঙ্খলায় অধঃপতিত হয়েছে?
দুই দলীয় অকার্যকর পদ্ধতির শিকার বাংলাদেশ। যেখানে দুই দলনেতা, ‘দ্য ব্যাটলিং বেগমস’ দেশকে রসাতলে যেতে দিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন। ১৯৯১ সাল থেকে তারা দু’জন পালাবদল করে ক্ষমতায় এসেছেন। উভয় দলই যেহেতু জানে অপর দল নির্বাচনে জালিয়াতি করবে, তাই নির্বাচন হতো অন্তর্র্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
২০০৬ সালে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য একটি সময়কাল সমাপ্তি হবার পর খালেদা জিয়ার দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি জালিয়াতি করার চেষ্টা করেছিল। নির্দলীয় একটি ‘টেকনোক্র্যাট’ সরকারকে সমর্থন দিয়ে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ওই সরকার দুই বছর পর নির্বাচন আয়োজন করে, যেখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। দলটি তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে, বিএনপি নেতাদের ধরপাকড় আর তাদের বড় জোট অংশীদার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে ভবিষ্যতে বিএনপির নির্বাচনে জেতা অসম্ভব করে তোলার চেষ্টা করেছে। সরকার এখন দাবি করছে তারা বিএনপির ধ্বংসাত্মক কর্মকা- এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করছে। এদিকে, সরকার একদলীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বলে বিরোধী দল দাবি করছে। উভয়ের কথাতেই যুক্তি আছে।
দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত বৈরিতা- বিজয়ীই সব কিছু পাবে রাজনীতিতে এমন নীতি লালনে সহায়তা করেছে। এখানে জালিয়াতির নিষ্ফল নির্বাচন বিরোধী দলকে রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। দেশজুড়েই দু’দলের অবস্থান দৃঢ়। টেকনোক্র্যাট সরকারের সময়ে এই দু’দলকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তৃতীয় শক্তির উত্থানে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা কোন ফল বয়ে আনেনি। রাজনৈতিক যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের প্রতিবেশীর সম্ভবত আগ্রহ নেই। এসব কিছুর পরেও বাংলাদেশে উন্নয়ন সফলতার ভালো রেকর্ড রয়েছে।
খালেদা জিয়ার প্রতি আস্থা নেই ভারত ও পশ্চিমাদের। তারা মনে করেন- চীনকে তিনি অধিকতর ভূমিকা পালনে অনুমতি দেবেন এবং কট্টর ইসলামপন্থিদের প্রতি তার রয়েছে নমনীয়তা। শেখ হাসিনা বলতে পছন্দ করেন যে, বাংলাদেশে বড় কোনো সন্ত্রাসী হামলা তার সময়ে হয়নি। অথবা অন্য কোথাও সন্ত্রাসী হামলার যোগসূত্র বাংলাদেশ পর্যন্ত আসেনি।
যাহোক, বিএনপির অবরোধে অস্থিরতা বাড়ছে। অগ্নিদগ্ধ মানুষে ভরে যাচ্ছে হাসপাতাল। দমন-পীড়নে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে হয়তো হস্তক্ষেপ করার কথা ভাবতে পারে সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে তারা লোভনীয় দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের রয়েছে সুনাম। তাই সরাসরি অভ্যুত্থানের বিষয়ে তারা সতর্ক হতে পারেন। চলমান অস্থিরতাকে সরকার রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে স্বীকার করবে না। নতুন নির্বাচনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ অবস্থায় জেনারেলরা এটা অনুধাবন করতে পারেন যে, সময় শেষ- একথা বলা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। যেমনটা তারা আট বছর আগে করেছিলেন। বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতিতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না।
দি ইকোনোমিস্ট’র প্রতিবেদনটি এখানে তুলে ধরা হলো:
Why Bangladesh’s politics are broken
Feb 2nd 2015, 23:50 by T.J. / BANYAN
FOR the past month Bangladesh, a country of nearly 160m people, has (yet again) been paralysed. The opposition leader, Khaleda Zia, has been confined to a party office in the capital, Dhaka. Her Bangladesh Nationalist Party (BNP) has been staging a nationwide blockade of roads, railways and waterways. The trigger for the unrest was a banned protest to mark the anniversary on January 5th of last year’s election, in which the incumbent Awami League, led by the prime minister, Sheikh Hasina, was re-elected easily thanks to an opposition boycott. Nearly 50 people have been killed and more than 10,000 opposition activists arrested. BNP leaders are mostly in jail, in exile or in hiding, and face criminal charges that will probably bar them from running in the next election. This week events appeared to be reaching a head. The government temporarily cut the electricity supply and internet cables to Mrs Zia’s redoubt. In addition to the crippling blockade, she called a three-day national strike from February 1st. Why has politics degenerated into this mess?
Bangladesh suffers a dysfunctional two-party system, in which the two party leaders, the “battling begums”, wage a personal vendetta at the country’s expense. From 1991 they have rotated in office. Because both parties know that the other will rig elections, polls used to be conducted under an interim caretaker administration. In 2006 Mrs Zia’s party, at the end of a particularly corrupt and incompetent stint in office, tried to rig that system too. The army stepped in to back a non-party “technocratic” government, which after two years held an election won in a landslide by Sheikh Hasina’s Awami League. The party has used its majority to entrench its power, and make it impossible for the BNP ever to win an election: by abolishing the caretaker system, hounding its leaders and banning its largest coalition partner, Jamaat-e-Islami, for its avowedly Islamic platform. Now the government claims it is combating acts of vandalism and terrorism by the BNP. The opposition accuses the government of trying to create a one-party state. Both sides have a point.
The personal animus between the begums has helped foster a winner-takes-all approach to politics in which the futility of rigged elections forces the opposition on to the streets. Both parties are entrenched across the country; attempts, during the technocratic interregnum, to encourage “third forces” to emerge to challenge them proved fruitless. Bangladesh’s neighbours are unable and perhaps unwilling to meddle in the political deadlock. Despite everything, the country has a fair record of developmental success. And India and the West distrust Mrs Zia, seeing her as both willing to allow China a greater role in the country, and as being soft on Islamist extremism. Sheikh Hasina likes to point out that on her watch no big terrorist attack has taken place in Bangladesh. Nor has one elsewhere been traced back to the country.
However, with the BNP’s transport blockade prompting growing unrest, and victims of arson attacks filling the burns units of hospitals, the climate of repression worsening, the army may feel compelled to intervene. Mindful of its reputation (and lucrative UN peacekeeping duties), it will be wary of an outright coup. But it seems highly unlikely the government can be persuaded to treat the unrest as a political crisis and call fresh elections. So the generals may feel, as they did eight years ago, that they have no option other than to call “time out” on a political brawl that neither side can win.
গলাকাটা মুরগির অর্থহীন নাচানাচি
সিরাজুর রহমান
আমার আব্বা-আম্মার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের সবাই তখন জীবিত। একাত্তরের নভেম্বরের শেষে আম্মা মারা যান। সবচেয়ে বড় ভাই পাকিস্তাান বিমানবাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা হলেও করাচিতে কোর্ট মার্শালের প্রতীায় সামরিক কারাগারে বন্দী ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে হুঁশিয়ার করে দেয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। আমরা পরবর্তী দুই ভাই যুক্তরাজ্যে ছিলাম। সব ছোট দুই ভাই পূর্ব পাকিহস্তানে থাকলেও আম্মা শেষ বিদায়ে তাদেরও হাতের মাটি পাননি। এরা কাছের এক গ্রামে লুকিয়ে ছিল। আব্বা যখন তাদের আম্মার জানাজায় আসতে নিষেধ করে খবর পাঠান মাত্র তখনই তারা মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছিল। এরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের ধরার জন্য পাকিস্তাানি সেনাদের একটা দল আমাদের বাড়িতেই শিবির গেড়ে ছিল।
একাত্তরের এই ছিল দেশের চেহারা। খুব কম পুরুষই নিজের বাড়িতে রাত কাটাতেন। গভীর রাতে পাকিস্তাানি সেনারা বিশ্বাসঘাতক চরদের দেয়া খবর অনুসরণ করে সব সম লোকেদের ধরে ধরে নিয়ে যেত। তারপর তাদের কী হতো প্রায়ই জানা যেত না। পাকিস্তাানি গুপ্তচরদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী আমাদের বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বকে এরা ধরে ধরে নিয়ে গেছে। পরে দেশের মানুষ দেখেছে এখানে-সেখানে রোদ-বৃষ্টি-ধৌত কঙ্কালের স্তাূপ। দেশে তখন কী ধরনের ত্রাসের রাজত্ব চলেছে পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে বোঝানো খুবই কঠিন- প্রায় অসম্ভব।
প্রায় সে ধরনেরই একটা অব¯’া আবার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছরে যারা মুখ খুলে গণতন্ত্রের, স্বাধীনতার, মানবাধিকারের কিংবা নির্বাচনের কথা বলেছেন তাদের অনেকে শহীদ রুমি, আমার বন্ধু সিরাজুদ্দিন হোসেন, জহির রায়হান কিংবা বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমেদের মতো গুম ও খুন হয়ে গেছেন। একাত্তরের রাজাকার, আর আল বদরেরা আসত মুখোশ পরে। বিগত ছয় বছরের ছিনতাইকারীরা এসেছে পুলিশের কিংবা র্যাবের ইউনিফর্ম পরে। আপাত দৃষ্টিতে পুরুষহীন বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধ্বজাধারীদের ধরিয়ে দি”েছ একাত্তরের মতোই ছিঁচকে বিশ্বাসঘাতকেরা সামান্য কিছু টাকার লোভে।
অপর দিকে, এদের মন্ত্রী বলতে ই”ছা করে না, কারণ এরা এমন নোংরা কথা বলেন ও কাজ করেন যে, শুনে গা ঘিন ঘিন করে। তাদের একজন ঘোষণা দিয়েছেন যারা নির্বাচন কিংবা গণতন্ত্রের কথা বলেন কিংবা বলেছেন তাদের খবর দিলে ৫০ হাজার টাকা, আর ধরিয়ে দিলে লাখ টাকা পুরস্কার। ওদিকে রাজধানীতে সরকারের পে সমর্থন দেখানোর জন্য রোজ কয়েক শ’ টাকা করে ভাড়া পা”েছন কর্মহীন আর দিনমজুরেরা। কর্মসং¯’ান আর সম্পদের বণ্টনের অপূর্ব ব্যব¯’া করে ফেলেছে অবৈধ সরকার!
আরো অনেক মিল দেখবেন একাত্তরের সাথে। গোড়ার দিকে হলেও মাঝে মাঝে এখানে- সেখানে অভিযান চালাত পাকিস্তাানি সেনারা। সাধারণত দেশের ভেতরে ঢোকার সাহস তাদের ছিল না। মাঝে মাঝে কয়েক ডজন সামরিক যান ভর্তি সৈন্য আর দুই-চারজন বিশ্বাসঘাতক চরকে নিয়ে এরা গেরিলা আক্রমণের মতো করে হামিলা চালিয়ে অতি দ্র“ত ঘাঁটিতে ফিরে যেত। হুবহু একই দৃশ্য দেখা যা”েছ এখন। রাজধানীর বাইরের বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন। প্রশাসন নিজেই এখন বিপন্ন বোধ করছে। জেলা প্রশাসকেরা বিজিবি প্রার্থনা করে চিঠি লিখে মন্ত্রীদের অ¯ি’র করে তুলেছেন। অত বিজিবি সরকার পাবে কোথায়? সুতরাং আরো ৫০ হাজার গোপালী পুলিশ নিয়োগ করো। পুলিশ বাহিনীর গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার সাহস অনেক দিন আগেই চলে গেছে। এখন রাজধানীর বাইরে যেতে হলে অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পুলিশ র্যাব ও বিজিবি ডজন ডজন গাড়ি ও ভ্যানের কনভয়ে চলাচল করে। বিভিন্ন সময়ে হলিউডের দৌলতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনেক ফিল্ম দেখেছিলাম। বাংলাদেশের তথাকথিত শান্তিরী বাহিনীর রাজধানীর বাইরে যাওয়ার দৃশ্য প্রায়ই আমাকে ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর কনভয় অভিযানের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
খাসি করে দেয়া পাঁঠা?
এসব ছবিও হয়তো শিগগির আর দেখতে পাবো না। বর্তমানে তারা যা করছে তার প¯‘ুতিস্বরূপ মিডিয়া নামে পাঁঠাটাকে তারা ২০০৯ সালেই খাসি করে দিয়েছিল। হারানো পৌরুষের স্মৃতি মনে করে খাসির দুঃখ হয়, ম্যা-ম্যা করে সে মনের আকুতি প্রকাশ করতে চায়। সেটাও সরকারের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মাঝে মাঝেই তারা দুটো-চারটে মিডিয়া-খাসি হত্যা করেছে এবং করছে। যারা খাসি হতে আপত্তি করেছে তাদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। সাহসী মাহমুদুর রহমানকে এত দিন বিনা বিচারে আটক রাখা এবং মাঝে মাঝে লোকচুর অগোচরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগও প্রবল। এখন হুকুমের গোলাম দুদককে দিয়ে মামলা সাজানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার পত্রিকা আমার দেশের মুদ্রণ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামী টেলিভিশনও বন্ধ আছে। এখন কোপ পড়েছে একুশে টেলিভিশনের ওপর। আমার কেন জানি মনে পড়ছে এককালে এ স্টেশনটি শেখ হাসিনার প্রিয়পাত্র ছিল। ও দিকে টেলিভিশনের টকশোতে কাকে আমন্ত্রণ করা যাবে আর কাকে যাবে না তার একটা অলিখিত তালিকা স্টেশনগুলোকে আগেই দেয়া হয়েছিল। তাতেও সরকারের মনঃস্তাুষ্টি হয়নি। টকশোর অতিথিদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের কুৎসা-নিন্দা বৃষ্টি শুরু হতে দেরি হয়নি।
সরকারের জানাই ছিল তাদের নির্বাচন চুরি, গণতন্ত্র চুরি ও স্বাধীনতা চুরির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটবেই। তার আগেই সম্প্রচার বিধির নামে মিডিয়া নামক খাসিটার চার পায়ে দড়ি বেঁধে দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে আবার টেলিভিশন স্টেশন মালিক ও সাংবাদিকদের সচিবালয়ে ডেকে পাঁচ মন্ত্রী একযোগে দলাইমলাই করেছেন। মনে রাখতে হবে যে মালিকপগুলোর মাথা নানা কারণেই সরকারের কাছে বাঁধা। এরা সাধারণত বিভিন্ন শিল্প-গ্রুপের মালিক। সরকারের অনেক নুন খেয়েছেন এরা, ভবিষ্যতেও খেতে হবে। হয়তো সরকারের চোখের সামনে গুরুতর অন্যায় কেউ কেউ করেছেন অতীতে, সরকার অপত্য স্নেহে মা করে দিয়েছে। এখন মাটিতে টেনে দেয়া লাইনের একচুল এ দিক-ও দিক পা দিলে অনেক দড়িতে এক সাথে টান পড়বে। আবার টেবিলের তলা দিয়ে ডান হাত-বাঁ হাতের কারবার তো হরহামেশাই হ”েছ। দুই-তিন মাস আগে এ রকম একটা গুজব শুনেছিলাম। সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। তবে একজন তথাকথিত বামপš’ী মিডিয়া ব্যক্তিত্বের রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি মোড় ফেরা ল করেছি।
ফলটা যা হওয়ার তাই হয়েছে। স্টেশন মালিক ও তাদের মিডিয়া কর্মীরা পাঁচ মন্ত্রীকে নাকে খৎ দিয়ে এসেছেন। অনির্বাচিত, অবৈধ সরকার যা বলবে সেটাকেই তারা ধ্রুব সত্য বলে প্রচার করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে কয়েক বছর পড়াশুনা করে এবং বহু বছর ধরে মিডিয়ায় কাজ করে তারা যা শিখেছেন সেটাকে আর সংবাদ বলা যাবে না। পাঁচ মন্ত্রী দলাইমলাই করে বলে দিয়েছেন আন্দোলন-অবরোধ উসকানি পেতে পারে এমন খবর প্রকাশ করা যাবে না। এবং বেছে বেছে ভালো খবরগুলো ছাপতে হবে। আমার মনে আছে পাকিস্তাানের জেনারেল ইয়াহিয়া খানও একই উপদেশ দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। এরও আগে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বলেছিলেন, আপনারা ভারতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করেন কেন, রবীন্দ্রনাথ তো পাকিস্তাানের বিরোধিতা করেছিলেন (সত্য নয়, লাহোরে পাকিস্তাান প্রস্তাাব পাস হওয়ার সময় থেকে গুরুতর অসু¯’ ছিলেন), রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনারা লিখতে পারেন না?
বিদেশীদের চোখে ঠুলি বাঁধা?
বাংলাদেশে এখন বলতে গেলে একমাত্র ঘটনা নিরপে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের দাবিতে অবরোধ আন্দোলন। সেটা সরকারের জন্য দুঃসংবাদ, কেননা দেশে অবরোধ চলছে শুনে ধীরে ধীরে আরো মানুষ অবরোধে শরিক হ”েছ। সুতরাং এ খবর প্রচার করা যাবে না। সুখবর কোনটাকে বলবেন তাহলে? মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, অবরোধ সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। পরি¯ি’তি কয়েক দিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন বলে আশ্বাস বিভিন্ন মন্ত্রী তিন সপ্তাহ ধরে দিয়ে চলেছেন। এমনকি কেউ এ দেশে আছেন যিনি মন্ত্রীদের আশ্বাসে বিশ্বাস করেন? সে খবর আপনি কী করে প্রচার করতে পারেন, কেননা অন্য কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অবরোধ-টবরোধ কি”ছু হ”েছ না, ওসব একদম বাজে কথা!
বিএনপির আন্দোলনের সময়ের ধ্বংসাত্মক ঘটনাগুলো বিদেশে প্রচার জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিকদের তাগিদ দি”েছন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিমন্ত্রণ করে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বলে বোঝাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, যে বিদেশীরা কোনো কোনো বাংলাদেশী মন্ত্রীর মতো স্টুপিড লোকেদের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায়নি। রাষ্ট্রদূতেরা পরি¯ি’তি দেখছেন এবং দেখে তার যথার্থ মূল্যায়নের মানসিক মতা তাদের আছে। সেজন্যই তারা এবং স্বদেশে তাদের সরকার হাজারবার করে বলছে দ্র“ত সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় এসে সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দাও, নইলে বাংলাদেশের সঙ্কটের অবসান হবে না।
শুনেছি এখন আবার অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির ভয়াবহ ছবি ডিভিডি করে বিদেশে পাঠানো হ”েছ সেসব দেশের সরকারকে জ্ঞানদান করার জন্য। প্রশ্ন উঠবে অবরোধ-হরতাল যদি মিথ্যা হয় তাহলে এসব ঘটনা ঘটছে কেন? এবং মনে রাখতে হবে এই সরকারগুলোই দুই বছর ধরে বাংলাদেশের সরকারকে সুপরামর্শ দিয়ে আসছে, আর ঢাকার সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। সুতরাং সরকারি উদ্যোগে পাঠানো ডিভিডিগুলো দেখে বিদেশী সরকারগুলো কুপোকাত হয়ে যাবে ভাবার কোনো কারণ আছে কি? তা ছাড়া বাংলাদেশে এখন ব্যাপক বলা-কওয়া হ”েছ যে বাসে-ট্রাকে আগুন লাগানোর অনেক ঘটনা সরকার পই ঘটা”েছ বিএনপিকে অপবাদ দেয়ার জন্য। এসব ঘটনার জন্য পুলিশ এ যাবৎ যাদের ধরতে পেরেছে তাদের মধ্যেও সরকার পরে লোক অনেক থাকছে। আরো স্মরণীয় যে, বাসে আগুন লাগানোর রাজনীতি বাংলাদেশে ‘প্রবর্তন’ করেছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের ৪ জুন আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে শেরাটন মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে ১১ জন যাত্রী হত্যা করার কথা আওয়ামী লীগ নেতারা ভুলে গেছেন? সে ঘটনার জন্য কাউকে হুকুমের আসামি করা যায় না? এসব খবর রাষ্ট্রদূতদেরও কানে যায় এবং তারা সেসব খবর এবং তাৎপর্য অবশ্যই স্বদেশে সরকারকে জানিয়ে দেন। ‘তোমাদের কথা আমি শুনব না, কিš‘ আমার কথা তোমাদের শুনতে হবে’- বাংলাদেশ সরকারের এই গোঁয়ার্তুমির মনোভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধোপে টিকবে বলে কেউ মনে করেন?
অনেক ব্যাপারের উল্লেখ করে ফেললাম। এগুলো অবশ্যই খবর। এগুলোর যেকোনোটা প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের দাবিতে একটা অবরোধ এবং সেই সাথে মাঝে মাঝে হরতাল চলছে। এবং আরো মেনে নিতে হবে যে প্রায় চার সপ্তাহ থেকে গ্রেফতার, গুম, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি চালিয়েও সরকার পরি¯ি’তি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সুতরাং মিডিয়াকর্মী যদি বর্তমান বাংলাদেশ সম্বন্ধে কোনো সংবাদই প্রচার না করেন তাহলেই শুধু মন্ত্রীদের হুকুম মেনে চলা তাদের পে সম্ভব হতে পারে।
লাশের রাজনীতির নতুন মাত্রা
শুধু বিশ্বসমাজই নয়, দেশের ভেতরের যেসব মহলের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা অত্যধিক তারাও এখন সরকারকে সংলাপে বসে সমঝোতায় আসতে এবং সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পরামর্শ দি”েছ। অস্বীকার করার উপায় নেই ব্যবসায়ী সমাজের উদার অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য বিগত ছয় বছরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরাট একটা খুঁটি ছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবরের লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলনের সময় থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জানাজানি হয়ে গেছে যে জনতা ভাড়া করতে, সে জনতাকে যথা¯’ানে নিয়ে যেতে বাস ও ট্রাক ভাড়া বাবদ বহু কোটি টাকা ব্যবসায়ীসমাজ আওয়ামী লীগকে দিয়েছে। সব দেশেই ব্যবসায়ীসমাজ সরকারের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে চায়। কিš‘ গণবিরোধী সরকারকে সমর্থন দেয়ার বেলায় তারা হুঁশিয়ার থাকে। সারা দেশের মানুষ যখন গণতন্ত্র চেয়েছেন, গণতন্ত্র না দিলে সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছেন, তখন ব্যবসায়ীসমাজ গণবিরোধী অব¯’ান নিয়েছে, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যব¯’া করে গণবিরোধী সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। ব্যবসায়ীসমাজের কান্নাকাটিতে এখন দেশের মানুষের মন গলবে কি?
সেই ব্যবসায়ীসমাজও এখন করজোড়ে সরকারের কাছে কাকুতি-মিনতি করছে, বলছে, ‘দয়া করে এবার সংলাপে বসুন, নইলে আমরা সর্বহারা হয়ে যাব।’ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লাঠালাঠি করতে গিয়ে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা সরকার আগেই হারিয়েছে। পাঁচ লাখ বিদেশী ম্যানেজার আমদানি করে গার্মেন্ট শিল্পের বারোটা আগেই বাজিয়ে দেয়া হয়েছে। মালিকেরা বলছেন, অবরোধ আর হরতালের কারণে বিদেশী বায়াররা ৪০ শতাংশ অর্ডার ইতোমধ্যেই বাতিল করে দিয়েছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট হোসেন খালেদ গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বলেছেন, অবরোধের প্রথম ১৬ দিনে তাদের লোকসান হয়েছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ডিসিসিআই এখন বলছে, বিএনপি ও ২০ দলের সাথে সংলাপই সঙ্কট নিরসনের একমাত্র পš’া। মাত্র সেদিন সুজন একই পরামর্শ দিয়েছে, সম্পাদকেরা তথ্যমন্ত্রীকেও বলেছেন একই কথা, দেশী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সং¯’াগুলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টসহ সব বিদেশী সাহায্যদাতা এবং ব্যবসায়িক অংশীদার সরকার ও সং¯’া বরাবরই এই একই কথা বলেছে। দেশে একজন ব্যক্তি কারো পরামর্শই শুনতে রাজি নন বলেই বাংলাদেশ অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে।
খালেদা জিয়ার স্বামীকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে। খালেদার অস্তিাত্ব বিলোপেরও কোনো চেষ্টার ত্রুটি রাখা হয়নি। খালেদাকে তার বাড়ি এবং চার দশকের সংসার থেকে উৎখাত করা হয়েছে, রাজনৈতিক মামলা সাজিয়ে তার ছেলেদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, ইট আর বালুর ট্রাক দিয়ে তাকে ভাড়া বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হয়নি, চার সপ্তাহ ধরে নিজের কার্যালয়ে প্রায়-শরণার্থী জীবন যাপন করতে তিনি বাধ্য হ”েছন। একের পর এক বেশুমার মিথ্যা মামলা সাজানো হ”েছ তার বিরুদ্ধে। তাকে নির্মূল করে দেয়ার নির্দেশের প্রতীা করছেন নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমান। সরকারের মন্ত্রীরা অনর্গল তাকে গ্রেফতার করার হুমকি দিয়ে যা”েছন। তার মানসিক স্বা¯’্য নষ্ট করাই যে সরকারের উদ্দেশ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঠিক এরকম পরি¯ি’তিতে তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন মালয়েশিয়ায়। মায়ের সীমাহীন ভোগান্তি যে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করেনি কে বলবে? এই আকস্মিক বজ্রপাতে খালেদা জিয়ার মনের অব¯’া কেমন হতে পারে সরকারের মন্ত্রীরা ছাড়া অন্য সবাই তা বুঝবেন। সঙ্গত কারণেই তার চিকিৎসক সিডেটিভ ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে খবর প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। খালেদার কার্যালয়ের সব খবর বিদ্যুৎ গতিতে তার কানে পৌঁছে যায়। বেছে বেছে ওই সময়টাতেই তিনি সমবেদনা জানাতে খালেদার কার্যালয়ে গেলেন। খালেদার উপদেষ্টা-সহায়কদের কি উচিত ছিল ওই অব¯’ায় তার ঘুম ভাঙিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির করা? প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা কোরাস জুড়ে দিলেন ঘুমন্ত খালেদা জিয়া জাগ্রত প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছেন। হাতে-পায়ে দড়ি বাঁধা, আর আগেই খাসি করা মিডিয়া ‘অপমান, অপমান’ বলে চিৎকার জুড়ে দিলো। হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে কি এমন একটিও দিন ছিল যে দিন তিনি খালেদাকে অপমান করার চেষ্টা করেননি?
জাতির জননী, গণতন্ত্রের জননী
পরলোকগত কোকোর দাফন নিয়েও পরস্পর বিরোধী প্রচারণার অবধি ছিল না। কেউ যেন এক মন্ত্রীর মাথায় ঢুকিয়েছিল আওয়ামী লীগ কোকোর দাফনে অংশ নিলে খালেদাকে শাস্তিা দেয়া হবে। পরে সে আইডিয়া পরিত্যক্ত হলো। শহীদ জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি জিয়ার ছেলে হিসেবে সামরিক গোর¯’ানে সমাহিত হওয়ার অধিকার কোকোর ছিল। সরকার সেখান থেকেও তাকে ‘নির্বাসিত’ করেছে। লন্ডনে কোকোর গায়েবানা নামাজে জানাজায় তারেক রহমান তার অতি আদরের ভাই সম্বন্ধে কিছু বললে তা প্রকাশ না করার নির্দেশ আগে থেকেই মিডিয়া-খাসিকে দেয়া হলো। এ দিকে দেশের কোথায় গাড়ি পুড়েছে, কোথায় পুড়েছে বাস এবং সেটা যে সরকারের লোকেরাই করেনি তার নিশ্চয়তা কী। এসবের জন্য খালেদাকে ‘হুকুমের আসামি’ করা হ”েছ। এবং মন্ত্রীরা তার গ্রেফতার নিয়ে এমন জল্পনা-কল্পনা শুরু করলেন যে কানে তালা ধরে গেল। পুলিশ, র্যাব আর বিজিবিতে ইউনিফর্ম পরা আওয়ামী লীগ ঠ্যাঙাড়েরাও যোগ দিলেন সে জল্পনায়। খালেদার মাথা খারাপ করার চেষ্টা করতে গিয়ে মন্ত্রীদেরই যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারা গলাকাটা মুরগির মতো অর্থহীন নাচানাচি করছেন।
আসলে এই মন্ত্রী ও ইউনিফর্মধারী আওয়ামী লীগ নেতারা আজো খালেদা জিয়ার আসল পরিচয় জানতে পারেননি। তার স্বামী বাকশালী স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া খুন হলেন সেজন্য। স্বামীর অসমাপ্ত কাজ কাঁধে তুলে নিলেন খালেদা। দৃঢ় হাতে বিএনপির হাল চেপে ধরলেন। সামরিক স্বৈরতন্ত্র আমদানি করে বাধা সৃষ্টি করা হলো। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বৈরতন্ত্রকে জিইয়ে রেখে গণতন্ত্রে উত্তরণ নয় বছর বিলম্বিত করলেন। খালেদা জিয়া হাল ছেড়ে দেননি। শত ভয়-ভীতি ও চোখ-রাঙানোকে উপো করে তিনি স্বৈরতন্ত্রকে টেনে নামালেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেন। বিগত ছয় বছরের নির্যাতন-নিপীড়নের কথা তো আগেই বললাম।
এক ছেলে সাত বছর ধরে নির্বাসিত। সাত বছরেরই নির্বাসনের পর অন্য ছেলে এখন মৃত, সদ্য সমাহিত। তার নিজের বিরুদ্ধে অজস্র সাজানো মামলা। অহরহ তাকে গ্রেফতারের, হত্যার ভয় দেখানো হ”েছ। শোকে-দুঃখে খালেদা জিয়া মৃতকল্প। এখন কী করবেন তিনি? গণতন্ত্রের আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে তসবিহ হাতে দিন কাটাবেন? েেপছেন? জাতি তাকে নেতৃত্ব দিয়েছে, গণতন্ত্রের জননী আখ্যা দিয়েছে। অর্ধমৃত হলেও মৃত তো তিনি নন। সুতরাং মাঝ নদীতে হাল ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খালেদা জিয়া শোক ঝেড়ে ফেলে আবার উঠে দাঁড়াবেন, স্বামীর অসমাপ্ত কাজ নতুন করে সমাপন করবেন। শত হলেও তিনি জাতির ও গণতন্ত্রের জননী।
(লন্ডন, ২৭.০১.১৫)
সিরাজুর রহমান: বিবিসিখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক
মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বিতর্ক
ফরহাদ মজহার
সম্প্রতি দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ২৮ জানুয়ারি তারিখে ‘চলমান জাতীয় সঙ্কট: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক একটি সভা করেছেন। সেই সভায় বিচারপতি আবদুর রউফ, খোন্দকার মাহবুব হোসেন, লে. ক. (অব:) মোহাম্মদ সেলিম, রুহুল আলম গাজীসহ আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তার জন্য তাঁকে ও সভার উদ্যোক্তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর অনেকেই দেখেছেন।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও সমাধান অন্বেষণ অবশ্যই ইতিবাচক। সভায় ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করা হবে তা আমি আগে জানতাম না এবং আমার সঙ্গে আগে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয় নি। ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া কারা এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাও জানি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল এবং সমাধানের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ আগের যেকোনো পরিস্থিতির তুলনায় কঠিন। এই ধরনের সংবেদনশীল সময়ে কোনো প্রস্তাব পেশ করার আগে তা নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা দরকার এবং বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হলেও কখন কিভাবে কোন ভাষায় তা হাজির করতে হবে সেই বিষয়েও বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি।
এটা ঠিক যে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ কথাটি নামকরণের দিক থেকে আওয়ামী লীগের পুরানা রাজনীতির অনুরণন, এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মার্কা ‘জাতীয় ঐকমত্য’কে প্রাধান্য দিয়েই নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননকে নিয়ে বর্তমানে যে সরকার রয়েছে সেটা জাতীয় ঐক্যের আওয়ামী ধারণা অনুযায়ী ‘ঐকমত্য’-এর সরকারই বটে। প্রফেসর এমাজউদ্দীন আগামী দিনের জন্য এই ধরনের একটি সরকারের অধিক কিছু ভাবতে পারছেন কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর লেখালিখির মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি। সে যা-ই হোক, সম্প্রতি তিনি শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়ে নির্বাচন হতে তো সমস্যা নেই’।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতি কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার মতো নয়। শ্রীলঙ্কায় হয়েছে বলে বাংলাদেশেই সেটা সম্ভব এটা ভাবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু তারপরও তিনি চাইছেন শেখ হাসিনার অধীনেই একটা নির্বাচন হোক। এ কথা বলার অর্থ শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করে বিশ দলীয় জোট ভুল করেছে! এখন তা সংশোধন করতে হবে। তাই কি?
তাঁর হঠাৎ আন্দোলনের মাঝখানে এ কথা বলার অর্থ কি? আগামী দিনে শেখ হাসিনার সরকারে যেভাবে এরশাদ, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন আছে তেমনি কি তিনি বিএনপির নেতাদেরও যোগদান চান? তাঁর কাছে সম্ভবত রওশন এরশাদের অধিক মর্যাদা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাই। তিনি কি চান রওশন এরশাদের মতোই খালেদা জিয়া হাসিনার সরকারে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসাবে যোগদান করুক? বিরোধী দলের আন্দোলনে যারা অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন ও বুকে গুলি নিয়ে শহীদ কিম্বা পঙ্গু হচ্ছেন, আগুনে পুড়ে মরছেন- সেই সকল নেতাকর্মীর কাছে এই ধরনের প্রস্তাব চরম অবমাননাকর বলে গণ্য হতে পারে। এই দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করবার কথা বলা ঠিক হয় নি।
তারপরও বলব ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ যা সঠিক মনে করেন তা বলার অধিকার তাঁর আছে এবং তাঁর কিম্বা অন্য যে-কারো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাতে আমার কোনোই আপত্তি নাই। তবে ২৮ তারিখে সভায় যখন ঘোষণা করা হলো যে এই প্রস্তাবে আমি স্বাক্ষর করেছি, তখন মঞ্চ থেকেই আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জানাতে হয়েছে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির কোনো দৃশ্যমান পরিণতি বিচার না করে এই ধরনের কোন প্রস্তাব আন্দোলন-সংগ্রামের বর্তমান চলমান মুহূর্তে আমি সমর্থন করি না, স্বাক্ষর করার প্রশ্নই আসে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো যেমন আছে তেমনি অক্ষত রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক পরে হাত থেকে আরেকটি পরে হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আমার রাজনীতি না। এই রাজনীতি আমি করি না। সাত দফার সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করবার ক্ষেত্রে বিরোধী জোটের আন্দোলনে ও কৌশলে ব্যর্থতা থাকতে পারে কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন চায়। অতএব আমাদের কাজ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে বিকশিত হতে পারে তার প্রতি মনোযোগী হওয়া। নির্বাচন তো হতেই হবে। সেটা কখন কিভাবে কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা আন্দোলনের সাফল্য বা পরিণতির ওপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন।
এরপরও কালের কণ্ঠ পত্রিকায় একটি খবর দেখে আমি অবাক হয়েছি। ‘শত নাগরিক’ নামক সংগঠনটির জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসাবে কবি আবদুল হাই শিকদার স্বাক্ষরিত সংবাদের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে ড. এমাজউদ্দীন আহমদের প্রস্তাবে যারা ‘একমত পোষণ করেছেন’ তাদের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আমার নাম দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! ফলে আমাকে আবারও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। আমি সুস্পষ্ট ভাবে সকলকে জানিয়ে দিতে চাই এই ধরনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি কখনই কোনো কালে ‘শত নাগরিক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না বা যুক্ত নই। (দেখুন, ‘এমাজউদ্দীনের প্রস্তাবে শত নাগরিকের সমর্থন’)
যেখানে চলমান সঙ্কট নিরসন দূরে থাকুক, তাকে আরো তিক্ত, কুৎসিত ও হিংস্রপর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য খালেদা জিয়ার বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হচ্ছে, তাকে না খেয়ে মারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ডিশ লাইন, ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করা হচ্ছে- সেই সময় শত নাগরিকদের উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাস্তায় নেমে আসা, প্রতিবাদ করা এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও নানাবিধ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। কিন্তু সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে অনেককেই এখন দেখছি আওয়ামী লীগের অনুকরণ কিম্বা অনুরণনে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় ঐকমত্য সরকার’ গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করছেন।
বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের কথা ও কাজে নিরন্তর নগ্ন ও কুৎসিত আক্রমণের মুখে ন্যূনতম প্রতিবাদে না গিয়ে উলটা সেই সরকারকে সাথে নিয়েই কি তারা ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের’ প্রস্তাব করছেন? কেন করছেন আমি জানি না। এই আবেদন নিবেদনের অর্থ কি তা আমি বুঝতে অম। ফলে আমার রাজনীতির সাথে ক্ষক্ষমতাসীনদের কাছে এই অবাস্তব আবেদন নিবেদনের কোন মিল আমি খুঁজে পাই নাই। চলতি রাজনৈতিক ক্রাইসিসে এটা কোন বাস্তবোচিত প্রস্তাব নয়। তাই আমি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই, যদি তা-ই হয়, তাহলে আমি তাদের সাথে একমত নই।
দুই.
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ ধারণা যদি ক্ষক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে আসত তাতে হয়তো কিছু আবেদন থাকত। এটা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আসায় আমি মনে করি এই মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে এই দাবি বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করতে পারে। দেশকে আরো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রস্তাব সাধারণ জনগণ বিশেষত যারা আন্দোলন সংগ্রামে জীবন দিচ্ছেন তাদের কাছে ষড়যন্ত্র গণ্য করবার কারণ হতে পারে। আশা করি, যারা তার প্রস্তাব করছেন তারা এসব বিবেচনায় নেবেন।
শেখ হাসিনা তো নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদি এটাই এখন চাই তাহলে তখন সেই প্রস্তাব লুফে নেওয়া হলো না কেন? যারা ক্ষমতাসীন রয়েছেন তাদের সমর্থনের বাইরে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ধরনের কোন অন্তর্র্বতী সরকার যদি আদৌ রাজনৈতিক কারণে গঠন জরুরি হয়ে পড়ে তাহলে ক্ষমতাবানরাই সেটা গঠন করে, তাহলে এখন এই ধরনের সরকার গঠনের শক্তির ভিত্তি কি? কারা এই সরকার গঠন করতে চাইছে? এটা কি আন্দোলন-সংগ্রামে বিজয়ী রাজনৈতিক পক্ষে নাকি ক্ষমতাসীন সরকার সদাশয় হয়ে এই ধরনের সরকার কবুল করবেন?
এই ধরনের প্রস্তাবের রাজনীতিকরণ না ঘটিয়ে অর্থাৎ এখনই সমাধানের প্রস্তাব হিসাবে পেশ না করে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিভাবে নতুন অন্তর্র্বতী ক্ষমতা তৈরি হয়, কিম্বা বিদ্যমান বাস্তবতা বিচার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সেটা তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সতর্ক প্রজ্ঞার কাজ। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো শুরুতেই উঠে আসে সেটা হোল কারা এই সরকার গঠন করবে? জাতীয় ঐকমত্যের সরকার তো বললেই গঠিত হয়ে যাবে না, বা চাইলেই গঠন করা যায় না; এর সঙ্গে সরাসরি ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত। সেই ক্ষমতা তৈরি হবে কিভাবে? কিম্বা সেই ক্ষমতা হাজির থাকলে সেটা কোথায় কিম্বা কারা? যারা ক্ষমতায় আছেন এবং ক্ষমতাবান তারা এই ধরনের সরকার চাইবেনই বা কেন? কিম্বা এই ধরনের সরকার গঠন করবার ক্ষমতা যাদের আছে তারা আদৌ এই ধরনের সরকার গঠনে শক্তি জোগাবে কি? যদি ক্ষমতাসীনেরা এই ধরনের সরকারে সমর্থন না দেয় অর্থাৎ যদি এই সরকার শেখ হাসিনার অধীন রওশন এরশাদ-ইনু-মেনন জাতীয় না হয় তাহলে এর পেছনের অনুমানটি কী? সেটা কি এই যে এর সমর্থন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, কিম্বা বিদেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আসতে হবে। অতীতে আমরা এমন দেখেনি যে তা নয়, কিন্তু তা সবসময়ই জনগণের স্বার্থের বদলে বিদেশী স্বার্থ রার নির্দেশ পালনের বিপদে আমাদের নিক্ষিপ্ত করেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিকশিত না করে এবং জনগণের ওপর আস্থা না রেখে রাষ্ট্রের সশস্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিম্বা বিদেশী কোনো পরাশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো বিচক্ষণ কিম্বা আদর্শ রাজনীতি নয়।
কিন্তু তার পরেও বলা যায় বর্তমান জাতীয় সঙ্কট থেকে বেরোতে হলে একটা অন্তর্র্বতীকালীন সরকার রাজনৈতিক ভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু রাজনৈতিক মীমাংসার তর্ককে শুধু আইনি ও সাংবিধানিক তর্ক হিসাবে দেখা ও দেখাবার জন্য আইন পেশার অনেককেই অতি উৎসাহিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। যেমন এখন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বৈধতা কী নিয়ে তা নিয়ে তারা বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা এখনো বুঝতে পারেন না বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো কন্সটিউটিউশনাল বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সাই সকল ক্ষমতা এবং তার বৈধতার উৎস, উকিলদের ওকালতি নয়, কিম্বা কোনো সংবিধানও নয়। উকিল মোক্তারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে প্রায়ই প্রকট রাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করে।
সংবিধানের বাইরে জনগণের ক্ষমতার ধারণা ও তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের নাই তা নয়। একাত্তর তো বটেই। এমনকি সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতাচ্যুতি কোনোটিই সাংবিধানিক ভাবে হয় নি। ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা অর্থাৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতই তাকে তাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে পরে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার সম্ভাবনা তখন দেখা দিয়েছিল। তাকে নস্যাৎ করে দিয়েই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রার নামে পুরানা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যার কুফল আমরা এখন হাড়ে হাড়ে ভোগ করছি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার হিসাবে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’-এর প্রস্তাব কোন পরিণত বিবেচনা থেকে পেশ করা হয় নি। রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা কথাটা প্রচলিত হলেও তার মানে আসলে কী সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা আমাদের সমাজে হয় নি। গণ-আন্দোলন ও রাজনীতিই একাত্তর কিম্বা সাতই নভেম্বরের মতো নির্ধারণ করে দেবে যে জনগণ কিভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা করবে। এটা আইনি বা সাংবিধানিক ব্যাপার মাত্র নয়। কোনো প্রস্তাব দিয়ে নয়, বরং সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেই মুহূর্ত আদায় করে নিতে হয়। ইতিহাস সেই স্যাই বারবার দেয়।
তবে এত কিছুর পরেও অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের প্রস্তাবের ইতিবাচক দিক হচ্ছে নির্বাচনকেই সমাধান গণ্য করলেও বর্তমান সঙ্কটের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার দিকটা তিনি নজরে এনেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বন্ধ করে দিয়েছে। সংশোধনীতে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি এটা বদলাতে চান এবং যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত সেই সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কারও করতে চান। কিন্তু বর্তমান সংবিধান মানবিক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করেছে এবং একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে সেই বিষয়ে তিনি নীরব। তিনি ততটুকুই সংস্কার চান যতটুকু নির্বাচনের জন্য দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান জরুরি সেই প্রয়োজনীয়তার কোনো ইঙ্গিতই তিনি দেন নি।
নির্বাচনের জন্য সংবিধানের সংস্কার বর্তমান সংবিধান রুদ্ধ করেছে, এটা তিনি ঠিক বলেছেন। যদি সংবিধান দিয়ে সংবিধান তিনি সংশোধন করতে চান তাহলে সেটা কি তিনি ক্ষমতাসীনদের দিয়ে করাবেন? সেটা হবে তাঁর ভাষায় বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা। অথচ সেটা সম্ভব নয় সেটাও তিনি জানেন। তাহলে সংবিধানের সংস্কার করতে হবে অসাংবিধানিক ভাবে। তাঁর ভাষায় ‘সংবিধান সংশোধন না করে’ করা। সেটা কেমন? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই মহৎ কর্ম নাকি করবেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সংবিধানে প্রেসিডেন্টের তো সেই ক্ষমতা নাই। তবুও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবেন। পরর্র্বতীকালে যে সংসদ গঠিত হবে ওই সংসদ প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশকে অনুমোদন দেবে। কায়দাটা পুরানা। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা বদলাও, তারপর সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘অবৈধ’ কাজ বৈধ করে নাও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট অসাংবিধানিক ভাবে সংবিধান বদলাতে চাইলে তাঁকে তা করতে দেবে কে? তার কোনো উত্তর আমার জানা নাই। শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের তা জানা থাকলে তিনি আশা করি আমাদের জানাবেন। যদি জনগণের ইচ্ছা ও সঙ্কল্পই ক্ষমতার উৎস ও বৈধতা হয়, তাহলে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে বৈধতা নিতে এত সাংবিধানিক ক্যারিকেচারের কী দরকার? (দেখুন, ‘প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে পারেন’, মানবজমিন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
তিন.
আমার বিভিন্ন লেখায় আমি বারবার বলেছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নির্বাচনে না, সেটা রাষ্ট্রগঠনের গোড়ায় নিহিত। একাত্তরে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে এই ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুদ্ধ করেছি ও জীবন দিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণায় যা সুস্পষ্ট ভাবে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়েছে। এই ইতিহাস অস্বীকার করবার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু স্বাধীনতার এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে একটি দলের আদর্শ ও কর্মসূচিকে বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশ বিভক্ত হয়েছে, সমাজ বিভক্ত হয়েছে আজ আমরা পরস্পরকে নির্মূল করতে উদ্যত। এই বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতায় আজ পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। তার সাংবিধানিক, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি আছে। যে ফ্যাসিবাদ দেশে কায়েম হয়েছে তার সমাধান ফল চলতি কনস্টিটিউশনের মধ্যে নাই। ফলে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা জনগণকে ভাবতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা বাংলাদেশকে বিভক্ত, রক্তাক্ত, হানাহানি, হত্যা, গুম ও সহিংস দলবাজির ক্ষেত্রে পরিণত করেছে- তাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জনগণের লড়াই ছাড়া কোনো স্থিতিশীল রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ গঠন অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। সাধারণ মানুষ বারবার প্রাণ দিতে থাকবে এবং তার ফল নেবে দুই পরে লুটেরা দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ বিভিন্ন গোষ্ঠি। নিজ কোটারি স্বার্থের জন্য যারা হেন কোনো হীন কাজ নাই যা করে না বা করতে পারে না। এই ভাবে দেশ চলতে পারে না।
যারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত তারা যেন বিভ্রান্ত না হন তার জন্য আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে একমত হওয়া তো দূরের কথা আমার কোনো দূরবর্তী সংশ্রবও নাই। এ ধরনের প্রস্তাব চলতি সঙ্কট মেটাতে কাজে আসবে না। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অধ্যাদেশ জারির কথা এমনকি নতুন অন্তর্র্বতী ক্ষমতা তৈরি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে সংলাপ শুরুর প্রস্তাবও হতে পারে কি না সে ব্যাপারেও আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। রাজনীতির পক্ষগুলো যদি আদৌ কোনো রাজনৈতিক সমাধান চায় তাহলে প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেই আসতে হবে।
ফরহাদ মজহার: কবি: কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : ভধৎযধফসধুযধৎ@যড়ঃসধরষ.পড়স
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)