রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

বিষাদসিন্ধু থেকে হাসিনাসিন্ধু প্রসঙ্গ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস

আ ব দু ল হ া ই শি ক দা র ্র পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র মাংসাশী প্রাণী হায়েনা নাকি তার টার্গেটের পিছনে মাইলের পর মাইল লেগে থাকে এবং যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে তার লালসা পূর্ণ করে থাকে। আমাদের বর্তমান সরকারকে ধরেছে এই হায়েনার রোগে। সোনা, দাদু, লক্ষ্মী, যাই তাদের বলা হোক, যত ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা ও চক্ষুলজ্জার ভয় দেখানো হোক, তারা তাতে কান পাততে রাজি না। তারা মরিয়া হয়ে, ক্রোধান্ধ গোঁয়ারের মতো, দাঁত ও নখে রাজ্যের ক্রুরতা নিয়ে আঠার মতো লেগে আছে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পিছনে। তারা ড. ইউনূসকে বেইজ্জত না করে, ‘সাইজ’ না করে ছাড়বে না। ড. ইউনূসকে ‘উচিত শিক্ষা’ না দিয়ে ছাড়বে না। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বরণীয়, সম্মানিত মানুষটির সম্মান ও মর্যাদাকে আওয়ামী রাজনীতির আদর্শ গোর¯’ান আজিমপুরে দাফন না করে বাড়ি ফিরে যাবে না। এতে তাদের নিজেদের পাছার কাপড় পাছায় থাকুক আর না থাকুক, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আমার দেশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘ড. ইউনূসকে হেয় করতে গিয়ে সরকার বিপাকে।’ প্রতিবেদনে দেখা যায় সরকারের পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের ইমেজের চাইতেও বড় হয়ে ওঠা লোকটিকে এমন বিরূপ পরি¯ি’তির মধ্যে ফেলবে যে আন্তর্জাতিক অঙ্গন তা দেখে বাহ্বা দেবে। তারা দলবেঁধে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে-পায়ে ধরে বলবে, সরি ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে। আর নোবেল কমিটি কান ধরে উঠবস করে বলবে, সত্যি একটা ‘সুদখোর’ ‘রক্তচোষা’ লোককে পুরস্কার দিয়ে কবিরা গুনাহ করে ফেলেছি। আপনি আমাদের সব গুনাহখাতা মাফ করে দিন। এবার আমরা আপনাকে নোবেল দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করতে চাই। দয়া করে আমাদের একটা সুযোগ দিন। প্লিজ! এ লক্ষ্যে, সরকারপ্রধান থেকে শুর“ করে অন্যান্য মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা একের পর এক বিষোদ্গার করে দূষিত করে ফেলেন পরিবেশ। ঠুনকো ঠুনকো মামলা দিয়ে ইউনূসকে দাঁড় করানো হয় কাঠগড়ায়। ভারত থেকে অমর্ত্য সেনকে আমদানি করে ঘটা করে উদযাপন করেছে বইমেলা। তারপর ‘জিন্দেগি জিন্দেগি’ গান গেয়ে ফেটে পড়েছে উল্লাসে। কিš‘ মানুষ ভাবে এক, আল্লাহ করে দেয় আরেক রকম। এজন্য ইউনূসের বদলে উল্টো বিপাকে পড়েছে সরকার। সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রথমে হতবাক হয়েছে দেশবাসী। তারপর বিশ্ববাসী। তারপর ঘৃণায় ধিক্কারে ফেটে পড়েছে সবাই। সরকারের অন্যায় ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে পৃথিবীর দেশে দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, ভুবন-বরেণ্য জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ, সং¯’া অব্যাহতভাবে ড. ইউনূসকে জুগিয়ে যা”েছন নৈতিক সমর্থন। খোদ নোবেল কমিটি ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়িয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। কমিটির সচিব এবরত্ খঁহফবংঃধফ বলেছেন, ‘নোবেলের গোপনীয় ৫০ বছরের রীতি মেনে বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে আমি হলফ করে বলতে পারি সাধারণত যেভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়, এদের ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’—এই বিবৃতির পর সরকারের চাহিদা মোতাবেক, ভারতীয় একটি গোয়েন্দা চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নরওয়ের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্র ‘ক্ষুদ্র ঋণের জালে’র নীলনকশা মাঠে মারা যায়। এদের উগড়ে দেয়া থুথুগুলো সরকারের মুখেই ফিরে আসে। সম্মান বেড়ে যায় ড. ইউনূসের। এ সময় প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র ্তুঞযব হবুিড়ত্শ ঃরসব্থং প্রকাশ করে এক বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন, ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সাল থেকেই তিনি লেগে আছেন ইউনূসের বির“দ্ধে। ২০০৬ সালে নোবেল পাওয়ার পর তা চরম আকার ধারণ করেছে। ব্রিটেনের বিখ্যাত পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে, ড. ইউনূসের বির“দ্ধে অপপ্রচারের ইন্ধনদাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সংখ্যায় লিখেছিলাম ড. ইউনূসের অপরাধ তিনি কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন? শেখ হাসিনা থাকতে তিনি কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন? শেখ মুজিব যে পুরস্কার জোটাতে পারেননি সে পুরস্কার তিনি কেন পেলেন? ড. ইউনূসের অপরাধ শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার নামে নয়, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ এখন পরিচিত ড. ইউনূসের দেশ হিসেবে! তাছাড়া তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ সংগঠনের কেউ নন। তিনি আওয়ামী লীগও করেন না। সেজন্য দেশের মানুষ কিংবা বিশ্ববাসী যাই বলুক, তাতে গা না লাগিয়ে, দুই কান কাটা বেকুবের মতো সরকার কোমর বেঁধে লেগে রয়েছে ড. ইউনূসের বির“দ্ধে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের বির“দ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে তদন্ত কমিটি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সং¯’া, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, মামলা দায়ের করেছে, অভিযোগ উত্থাপন করেছে, নাকচ করে দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের কর অব্যাহতি, সরকারের পা-চাটা গভর্নর আতিউর রহমানের বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়েছে ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব পালন বৈধ নয়। ড. ইউনূসের কর্তৃত্ব অবৈধ। সরকার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দিল এই কর্মবীরকে। সরকারের চাহিদামাফিক আদালত ড. ইউনূসের আপিল দিল খারিজ করে। এ সময় ড. ইউনূস আশঙ্কা প্রকাশ করলেন (৭ মে ২০১১) গ্রামীণ ব্যাংক টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে। সরকারের গুণ্ডারা ড. ইউনূসের ডাকে সারা দেয়ার জন্য ৭ মে তারিখেই গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা সগির রশীদ চৌধুরীকে পিটিয়ে নাস্তানাবুদ করেছে। হত্যার হুমকি দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রেন্ডস অব গ্রামীণ বললেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যা করছে তা লজ্জাজনক। সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য শুর“ করল প্রক্রিয়া। সরকারের ক্রিপা ভিখারি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক নানা কৌশলে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুসন্ধান কমিটি থেকে ড. ইউনূসকে বাদ দিয়ে বাহ্বা নিল। মত্স্য চাষ প্রকল্প থেকেও বাদ পড়ল গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ক্ষমতা খর্ব করে দিল সরকার। বলা হলো এখন থেকে সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি পরিচালনা করবে ব্যাংকটি। ইতোমধ্যে গত ৭ আগস্ট ২০১২ ড. ইউনূসের বির“দ্ধে সরকার লেলিয়ে দিল এনবিআরকে। নিউইয়র্ক টাইমস আবার লিখল—গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে বাংলাদেশীরা বর্তমান সরকারকে ক্ষমা করবে না। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে জোর করে বের করে দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি সরকার। তারা এখন গ্রামীণ ব্যাংককেই ধ্বংস করে দিতে উদ্যত। ইতোমধ্যে ব্যাংকটিকে ভেঙে ১৯ টুকরা করার আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে সরকার। রাজনৈতিক জেদের বলে এই রকম অপকর্মে সরকার তত্পর বলে নিন্দার ঝড় উঠে দেশে-বিদেশে। তারপরও সরকারের কমিশন চালিয়ে যায় ধ্বংসের নীলনকশা প্রণয়নের কাজ। অর্থাত্ সরকার পিছু ছাড়ছে না ড. ইউনূসের। এইসব ডামাডোলের মধ্যে অথবা কৌশলগত কারণেই হয়তো সরকার গুটিয়ে নিয়েছে তার অশুভ গ্রামীণ কমিশন। এই নোংরা কমিশনের চেয়ারম্যান বোধ করি নিজের পিঠের চামড়া বাঁচানোর জন্যই প্রতিবেদন জমা না দিয়ে বিদেশে পগাড় পার হয়ে গেছেন। কিš‘ আরও কিছু রঙ্গ বাকি ছিল। সেই রঙ্গ দেখাতেই বোধকরি একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারওয়ারকে প্রধান করে গঠন করে বসেছে আরেক কমিটি। ড. ইউনূসের জুতোর যোগ্য নয় এমন এক লোককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের বিধিমালা প্রণয়ন করার জন্য। অর্থাত্ এটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার, ক্ষমতার শেষ মুহূর্তে এসে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকার। চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারিকরণের সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ড. ইউনূসের পিছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে আরও কয়েকটি সং¯’াকে। যারা এখন দেশ-বিদেশ তোলপাড় করে খুঁজে বেড়া”েছ ড. ইউনূসের মল-মূত্র। মোট কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন ড. ইউনূস। আর এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সরকারের রোষ কষায়িত চোখের হুঁশিয়ারি পেয়েছে ইউনূস সেন্টার। কারণ ইউনূস সেন্টার প্রতিবাদ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কথার। প্রধানমন্ত্রীর কথা, ‘ড. ইউনূস একজন স্বার্থপর মানুষ, তিনি নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারেন।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘নরওয়ে টেলিনর কোম্পানি প্রফেসর ইউনূসের জন্য লবি করেছে, টেলিনর বিশাল অঙ্কের টাকা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দিয়েছে, যাতে তারা ইউনূসের জন্য নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘একটি শক্তিশালী দেশ প্রফেসর ইউনূসকে এদ্দিন মদত দিয়ে এসেছে। এমন দিন বেশি দূরে নয় যেদিন সে দেশের মানুষ প্রফেসর ইউনূসের অজানা সব তথ্য জেনে যাবে। তখন তারা প্রফেসর ইউনূসের কাছ থেকে সব সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য তাদের সরকারের ওপর চাপ দেবে। সে দেশের সরকার যখন মুখ ফিরিয়ে নেবে—তখন প্রফেসর ইউনূস যাবেন কোথায়?’ এই তিনটি বিষয়ের বিস্তারিত প্রতিবাদ ইউনূস সেন্টার পত্রপত্রিকায় দিয়ে বলেছে ‘সরকার ইউনূসের বির“দ্ধে এসব কাণ্ডকারখানা পরিচালনা করে দুনিয়ার সামনে নিজেকে ভণ্ড প্রমাণিত করে যা”েছ।’ আর যায় কোথায়? তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে সরকার। বলেছে সাবধান। এখনই আমাদের কথার বির“দ্ধে যা বলেছ তা প্রত্যাহার কর। নইলে আইনি ব্যব¯’া নেব। তবে র্যাবের ক্রসফায়ার বা রিমান্ডে নিয়ে হাড়হাড্ডি ভাঙার কথা অবশ্য হুশিয়ারিতে ছিল না। ইউনূস সেন্টার কেন যে সরকারকে ‘গবেটদের সংঘ’ বলেনি সেটাও এক জিজ্ঞাসা। কারণ একেবারে মাথা মোটা কাতলা মাছের চাইতেও ফালতু কথা বলে বসেছে আমাদের কর্তারা। প্রফেসর ইউনূস স্বার্থপর? কি কারণে, কি জন্য, কাদের জন্য? আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই দাতা হাতেমতাই! মুনাফাকেন্দ্রিক বিশ্বকে বদলে দিতে তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’ নিয়ে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে জয় করে নি”েছন একের পর এক সাফল্যের মুকুট, তিনি স্বার্থপর! যিনি ৯০ লাখ গরিব নারীকে পথের দিশা দিয়েছেন তিনি স্বার্থপর! যিনি লাখ লাখ লোকের কর্মসং¯’ান করে একটা টাকাও ঘুষ নেননি—যিনি কোনোদিন কোনো হলমার্ক, পদ্মাসেতু, দেশপ্রেমিক কালো বিড়াল পোষেননি—তিনি স্বার্থপর? যিনি পিলখানায় এক ফোটাও রক্ত ঝরাননি, তিনি স্বার্থপর? আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, দীলিপ বড়ুয়ারা, সৈয়দ আবুল হোসেনরা সব হাজী মোহাম্মদ মুহসীন! প্রধানমন্ত্রীর কথা সত্য ধরলে, ড. ইউনূসের জন্য নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি ঘুষ দিয়েছে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে। আর ক্লিনটন ফাইন্ডেশন ঘুষ দিয়েছে নোবেল কমিটিকে। হায় খোদা, খাইছে আমারে! ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ঘুষ খায়! হিলারীর ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হওয়া শেষ। টেলিনর কোম্পানির মালিক হলো নরওয়ে সরকার। আর নরওয়ে হলো দুর্নীতিমুক্ত দেশ। বিশ্বের নন্দিত একটি দেশ। আর আমাদের দেশের, মাশাআল্লাহ দুর্নীতি এখন বিশ্ববিশ্রুত। খোদ প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের বির“দ্ধে যে দেশে নানা ঘুষের অভিযোগ—সেই চালুনি নিন্দা করে সুচকে? যাই কোথায়। আমার মনে হয়, মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দিয়ে যে ডিগ্রি বাণিজ্য হয়েছিল, সেই স্মৃতি থেকেই হয়তো তিনি এরকম বলছেন। নোবেল কমিটি ঘুষ খায়! এটা কি ডা. মোদা”েছর নাকি তৌফিক-এ-এলাহী পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান? অবশ্য এর আগে আমাদের অতি বুদ্ধিমান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাহেব বলেছিলেন, সাদা মদ আর স্যান্ডউইচ খেলেই নোবেল পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি মদের দিকে যাননি। প্রধানমন্ত্রীর এই বাণীতে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী নরওয়ের সরকার ও জনগণ নিশ্চয়ই অতিশয় প্রীত বোধ করবে—তাই না? যাই হোক দীপু মনির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর আগে ড. ইউনূসকে বিশ্বময় কালিমামলিন করার জন্য দেশে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের মনগড়া নানা অভিযোগের বস্তা বস্তা, দিস্তা দিস্তা দলিলপত্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করে তাদেরই ওয়েবসাইটে ড. ইউনূসের দুর্নীতি ও অনাচারের কল্পকাহিনী পাঠিয়েছে। আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের মতো ভাগ্যিস তারা অতি কল্পনা শক্তিতে বিশ্বাসী নন। তাই তারা সে সব পাত্তা দেয়নি। একটা গল্প মনে পড়ল, এক মদখোর খেতে খেতে মাতাল হয়ে গেছে। সে অন্যটাকে বলছে, ‘দোস্ত তুই কিš‘ আর মদ খাসনে। তুই এখনই ঝাপসা হয়ে গেছিস।’ আমাদের মহাজোটের মহাজট বাঁধানো সরকার আশায় বসে আছে তাদের অপপ্রচারে বিশ্ব একদিন ঠিকই বিভ্রান্ত হবে। তখন ড. ইউনূসের হবে কি? ড. ইউনূসের পরিণতির চিন্তা না করে, বিনয়ের সঙ্গে বলব, নিজেদের চরকায় তেল দিন। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে দেখুন, আপনাদের কি পরিণতি হয়। যা হোক, মোট কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রোধানলে পড়েই ড. ইউনূসের ওপর নেমে এসেছে নানা দুর্ভোগ। এজিদ ক্ষেপে গিয়েছিল হোসেনের ওপর। তাকে খলিফা বলে স্বীকার করে না বলে। শেখ হাসিনা ক্ষেপেছেন, তিনি থাকতে ইউনূস নোবেল পেয়েছেন বলে। এখন দরকার ছিল আর একজন মীর মশাররফ হোসেনের। মীর মশাররফ রচনা করেছিলেন বিষাদসিন্ধু, এখন সে রকম কেউ থাকলে হয়তো লিখে ফেলতে পারতো ‘হাসিনা সিন্ধু’। অবশ্য মীর মশাররফ বিষাদসিন্ধুর নাম এজিদসিন্ধু দেননি। দিলেও দোষ হতো না। কারণ এজিদের কারণেই ঘটে যায় কারবালার মর্মš‘ত ঘটনা। সে হিসেবে ঘটনা প্রবাহ যাই হোক, বিষাদসিন্ধুর মূল কেন্দ্রে ছিল এজিদ। আর এদিকে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নিয়ে যা কিছু হ”েছ, তার মূল কারণ কিš‘ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি ও ড. ইউনূস নন। সবকিছু আবর্তিত হ”েছ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কারণে। সে হিসেবে পরবর্তী গ্রšে’র নাম ‘গ্রামীণ সিন্ধু’ কিংবা ‘হিংসার সিন্ধু’ও হতে পারে। তবে, সাধারণ জনগণের বোঝার সুবিধার জন্যই ‘হাসিনা সিন্ধু’ নামের প্রস্তাব করে রাখছি অনাগতকালের লেখকের জন্য। দুই মীর মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি বিষাদসিন্ধুর ‘মহররম পর্ব’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। এ গ্রš’ রচিত হয়েছিল টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে। মীর তখন দেলদুয়ার স্টেটের ম্যানেজার। মহররম পর্ব উত্সর্গ করা হয়েছিল মহীয়সী বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমননেসা খাতুনকে। দ্বিতীয় খণ্ড ‘উদ্ধার পর্ব’ মীর রচনা করেন ১৮৮৭ সালে। আর শেষ খণ্ড এজিদ বধ পর্ব রচিত হয় ১৮৯১ সালে। পরে বিষাদসিন্ধুর তিনটি খণ্ডই একত্রে প্রকাশিত হয়। বিষাদসিন্ধু নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন এ হলো ইতিহাস, কারো মতে উপন্যাস। অনেকে বলে থাকেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র গদ্যলিখিত মহাকাব্য। এ কোনো ধর্মগ্রš’ নয়। তবে যে কথাই বলুন না কেন, বিষাদসিন্ধু অজর অমর। গবেষকরা প্রায় সবাই বলেছেন, মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক চরিত্র যেমন রাবণ, বিষাদসিন্ধুর তেমনি এজিদ। হোসেন নন, এজিদ এ গ্রšে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র। এজিদের লোভ-লালসা, ই”ছা-অনি”ছা উত্থান-পতনের সঙ্গে বিষাদসিন্ধুর পর্ব প্রবাহ এবং গতি পরিবর্তিত হয়েছে।—বিষাদের উত্তাল তরঙ্গসমূহের উত্স এজিদের হৃদয়সিন্ধু। এজন্যই বন্দিনী জয়নাবের সামনে এজিদের আর্ত হাহাকার, ‘কে না জানিল যে দামেস্কের রাজকুমার মৃগয়ায় গমন করিতেছেন। শত-সহস্র চক্ষু আমাকে দেখিতে ঔত্সুক্যের সহিত ব্যস্ত হইল, কেবল আপনার দুইটি চক্ষুই ঘৃণা প্রকাশ করিয়া আড়ালে অন্তর্ধান হইল। ... এ ভীষণ সমর কাহার জন্য? এ শোণিত প্রবাহ কাহার জন্য।’ বিষাদসিন্ধুতে এজিদের লোভ-লালসার ফলে এক ভয়ংকর অসম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হোসেনের পরলোক গমন সমাপ্ত হলো। কিš‘ এজিদের আসল উদ্দেশ্য জয়নাব লাভ হলো না। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, অন্যায় ও অত্যাচারের বির“দ্ধে মরণপণ লড়াই করে হোসেন শহীদ হলেন। শহীদ হয়ে তিনি মানব জাতির এক মহানায়কে পরিণত হলেন। অন্যদিকে বিজয়ী হয়েও এজিদ চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হয়ে রইলেন। হয়ে রইলেন এক জঘন্য খলনায়ক। রাজ্য, ক্ষমতা, প্রতাপ কোনোকিছুই তাকে এই গ্লানি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। উদ্ধার পর্বে মীর বলেছেন, ‘হুতাসনের দহন আশা, ধরণীর জলশোষণ আশা, ভিখারির অর্থ লাভ আশা, চক্ষুর দর্শন আশা, গাভীর তৃণভক্ষণ আশা, ধনীর ধন বৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা, আশার যেমন নিবৃত্তি নাই, হিংসাপূর্ণ পাপ হৃদয়ের দুরাশারও তেমনি নিবৃত্তি নাই—ইতি নাই। যতই কার্যসিদ্ধি, ততই দুরাশার শ্রীবৃদ্ধি।’—এই দুরাশার জন্যই এজিদ হয়ে পড়েছিলেন দাম্ভিক, অহংকারী ও নিপীড়ক। এর ফলও তাকে ভোগ করতে হয়েছে। কারণ ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে লোভী শাসকরা সব সময়ই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সবকিছুকে ছলেবলে কৌশলে পেতে চায় নিজ করতলে। বাধা পেলেই সে হয়ে ওঠে সংহারক। বিষাদসিন্ধুর মহররম পর্বে বিজয়ী এজিদকে তার বিচার-বুদ্ধির ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে উদ্ধার পর্বে। নিয়তি তার জন্য সৃষ্টি করেছে ট্র্যাজেডি। ডেকে এনেছে ধ্বংস। তার পাপে, তার দোষে একের পর এক যুদ্ধে হানিফার হাতে বিধ্বস্ত হয়েছে তার সেনাবাহিনী। বিলুপ্ত হয়েছে প্রতাপ। নিভে গেছে ঐশ্বর্য। আত্মবিমোহিত এজিদ তারপরও তার জন্য নিয়তি নির্ধারিত ঘৃণিত পরিণাম জেনেও লড়াই করে করে হয়েছে হতবল, নিঃস্ব, রিক্ত। বিষাদসিন্ধুর শেষ পর্ব সেজন্যই নামকরণ হয়েছে এজিদ বধ পর্ব। অর্থাত্ মহররম পর্বের পরেই থাকে উদ্ধার পর্ব। থাকে এজিদ বধ পর্ব। সোজা কথা প্রতিটি ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে। আমাদের শাসকরা এই কথাটি ভুলে যায় বলেই তাদের সহ্য করতে হয় জনতার ঘৃণা, কালের কটাক্ষ। তারপর নিয়তি তাদের জায়গা করে দেয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। এজন্যই বলা যায় ‘উদ্ধার পর্ব’ আসন্ন। নিরস্ত্র ড. ইউনূসই বিজয় লাভ করেছেন। তবে পরাজিত কে—তার নাম বলে জেলে যেতে চাই না। সীতা হরণের ফল যার ভোগ করার কথা সেই তো ভোগ করবে।