বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩

বাংলা সাহিত্যের সংগ্রামী ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিক পল্লী কবি জসিমউদদীন,,,,

মোঃ নজরুল ইসলাম
একবার এক সাহিত্য সভা থেকে ফিরছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।পদ্মার উপর নৌকায় বসে, হঠাৎ নৌকা একটু বেসামাল হয়ে উঠল। নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গী গোলাম সাবদার সিদ্দিকি মাঝিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন 'মিয়া একটু সাবধানে নৌকা চালাও এখানে বাংলা সাহিত্যের বড় বড় সব কবিরা আছেন'। বৃদ্ধ মাঝি সেকথা শুনে কার্যত হতবাক হয়ে পড়লেন। তাঁর ধারণা জসীমউদ্দীনের পরে কেউ কবি হতে পারেন না। এমনকি স্বয়ং নির্মলেন্দু গুণের পিতাও পদ্মানদীর মাঝির মত মনে করতেন বাংলা সাহিত্যে কবি বলতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীমউদ্দীন।তাঁর ছেলে যে কবি পিতা সেকথা বিশ্বাসই করতে চাননি। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের অসম্ভব জনপ্রিয়তার অনেকটা হদিশ মেলে প্রবীন মাঝি কিংবা নির্মলেন্দু গুণের পিতার বিশ্বাসে। কাজী নজরুল ইসলামের যদি হয 'বিদ্রোহী', জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন ', জসীমউদ্দীনের তেমন 'কবর'। খুব ছোট বয়সে প্রেম, বিদ্রোহের কবিতা না লিখে জসীমউদ্দীন লিখেছেন স্বজনহারা বৃদ্ধের করুণগাথা। কবিতা পড়ে পাঠকরা বুঝতে পারেন না এই কবিতা এক তরুণের সৃষ্টি। কুষ্ঠিয়া থেকে ডাক পেলেন এক সাহিত্য সভায়। সেটা তাঁর জীবনের প্রথম কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়া। সংগঠকরা কবিকে চেনেন না, কবি রেলস্টেশনে নেমে দেখলেন কেউ তাঁকে অভ্যর্থনা করতে আসেন নি। তবে বিশ, পঁচিশের মত লোক ছিলেন,তারা কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। জসিমউদ্দীন তাদের বলতে উত্তর পেলেন কবি জসীমউদ্দীনের এই গাড়িতে আসার কথা,তারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। তরুণ কবি নিজের পরিচয় দিলেও তাদের বিশ্বাস হল না। পরে অবশ্য ভুল ভাঙলে বিস্ময়ের পালা। জসীমউদ্দীনের 'কবর' যখন ম্যাট্রিক ক্লাসের পাঠ্য হয় কবি তখনও বি এ পাশ করেন নি। দীনেশচন্দ্র সেন জসীমউদ্দীন কে বলেছিলেন 'তোমার কবিতাটি ম্যাট্রিক ক্লাসের পাঠ্য হয়েছে আমার যতদূর জানা আছে পৃথিবীর কোনও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্রের লেখা এ পর্যন্ত পাঠ্য হয় নাই '। সবসময় স্বপ্ন দেখতেন কলকাতায় সাহিত্য মহলের স্বীকৃতি। মনে মনে বিশ্বাস করতেন কলকাতায় আসলেই তিনি কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাবেন। তবে জসীমউদ্দীনের পিতৃদেবের এই বিষয়ে একদমই সায় ছিল না, বরং তিনি মনে করতেন পুত্রের এই কবিতা লেখার নেশায় পড়াশোনা ক্ষতি হচ্ছে।দেশে তখন ইংরেজ বিরোধীতা বাড়ছে,পল্লীকবিও পড়াশোনা ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। উঠলেন বোনের বাড়িতে। তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় নিজেই অর্থের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। শুরু করলেন রাস্তায় নেমে খবরের কাগজ বিক্রি। গরম -গরম খবর হেঁকে বিক্রি করতেন। মানুষ আকৃষ্ট হতেন তাঁর বলার ভঙ্গিমায়।বহু সময় খরচ আর পরিশ্রমের পর সব কপি কাগজ বিক্রি হলে লাভ হত চোদ্দ পয়সা।এর সঙ্গে কবিতা লেখা চলছিল। সত্যি সত্যি জসীমউদ্দীনের কাব্যপ্রেম, সাহিত্য চর্চা,গ্ৰাম্য গান সংগ্ৰহে ব্যস্ত থাকায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে।বি এ পাস করতে অনেক বছর লেগে যায়।যে বছর নক্সী-কাঁথার মাঠ প্রকাশ হল সেই বছর তিনি স্নাতক হলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অবনীন্দ্রনাথের কাছে অনেকদিন ধরে যাওয়ার সুযোগ হলেও কবিগুরুর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে একদিন জসীমউদ্দীন গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। নিজের দুটো বই কবিগুরুর হাতে তুলে দিলে তিনি বলেছিলেন তোমার বই আমি পড়ব। পরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীন কে শান্তিনিকেতনে থেকে সেখান থেকে এম এ পরীক্ষা দিতে বললেন। অবশ্য সেই অনুরোধ তিনি রক্ষা করতে না পারলেও পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দরাজ প্রশংশা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা,রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই,এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না। পরিশেষে হয়ত মনে প্রশ্ন জাগে জসীমউদ্দীন কাদের কবি! সমালোচক, পাঠকরা একটি বিষয়ে হয়ত একমত হবেন অনেকেই গ্ৰাম নিয়ে লিখেছেন কিন্তু জসীমউদ্দীন যে গ্ৰাম নিয়ে লিখেছেন তার স্বাদ অন্যরকম।তার কবিতায় প্রকৃতির থেকে মানুষ বড়। তিনি গ্ৰাম দেখেছেন গ্ৰামের মানুষের চোখ দিয়ে। সেখানেই তাঁর কবিতা ভিন্ন,স্বকীয়, আলাদা রূপ,রসে পরিপূর্ন। তবে নিন্দুক বলতেন কবি নাকি বেশ কৃপণ ছিলেন, তাঁর নিজের বিয়ের দিনে শ্যালিকারা অনেকক্ষণ দরজা আটকে রেখে কিছুতেই একটি পয়সা আদায় করতে পারেন নি। খেতে ভালবাসতেন মুড়ি ভাজা।মুটের মাথায় বই চাপিয়ে একদিন অন্তর বাংলা বাজারে যেতেন তাঁর সৃষ্টি ও কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা অশেষ,,

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন