বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১২
সৌদি কূটনীতিককে গুলি করে হত্যা
ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব খালাফ আল-আলী আল সাফাহ আল ফালাহকে (৪৫) গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক জোনের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রাখে। গুরুতর আহত অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ভোররাতে মারা যান তিনি। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, রাত সাড়ে ৩টায় পুলিশ তাকে নিয়ে আসে। ওই সময় কর্তব্যরত চিকিত্সক ওই কর্মকর্তাকে মৃত ঘোষণা করলে পুলিশ লাশ ইউনাইটেড হাসপাতাল মর্গে রেখে চলে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সকালে জানতে পারে নিহত ব্যক্তি সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা।
কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে—তা জানা যায়নি। পুলিশও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। ধারণা করা হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে দ্রুত একটি প্রাইভেট কারে করে পালিয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে নিহত কর্মকর্তার বাসভবনের মাত্র একশ’ গজের ভেতরে। এসময় তিনি নৈশভ্রমণ শেষে বাসায় ফিরছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে গেলেও এ বিষয়ে তারা মুখ খুলছেন না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দুপুরে সচিবালয়ে বলেছেন, ‘আমরা নিহত সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। বিষয়টির তদন্ত চলছে, তদন্তের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
গতকাল সকালে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তারা খালাফ আল-আলীর মৃতদেহ দেখতে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যান। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে র্যাব, সিআইডি ও বিপুলসংখ্যক পুলিশ। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নিয়েছে। আরও আলামত সংরক্ষণের জন্য তারা ঘটনাস্থল কর্ডন করে রেখেছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, রাত সোয়া ১টার দিকে গুলশানের ১২০ নম্বর রোডে পর্তুগাল দূতাবাসের দেয়াল ঘেঁষে একটি স্থানে ওই কর্মকর্তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পায় পুলিশ। তার বুকের বাম পাশে একটি গুলি বিদ্ধ ছিল। তাকে উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান তার মৃত্যু হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান জোনের ডিসি লুত্ফুল কবির জানান, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হলেও তিনি জীবিত ছিলেন। পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়ার পর ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। গুলশান জোনের পুলিশের এডিসি নিজামুল হক মোল্লা জানান, গভীর রাতে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়ার পর প্রথমে তার পরিচয় জানা যায়নি। অজ্ঞাত হিসেবেই খালাফ আল-আলীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। নিহত খালাফ সৌদি দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব (হেড অব সৌদি সিটিজেনস অ্যাফেয়ার্স) ছিলেন। তিনি সৌদি নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি দেখতেন।
জানা যায়, ১২০ নম্বর রোডের ২২/এ (বিটিআই) ভবনের চারতলার এ/৪ ফ্ল্যাটে থাকতেন খালাফ আল-আলী। তিনি এখানে প্রায় দু’বছর ধরে আছেন। ওই বাসার নিরাপত্তাকর্মী তাপস রেমা জানান, খালাফ প্রায় সময়ই নৈশভ্রমণে বের হতেন। আবার রাতেই ফিরে আসতেন। সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় খালাফ আল-আলী বাসা থেকে হাঁটতে বের হন। মাঝেমধ্যে তিনি বাইসাইকেল নিয়েও বের হতেন। তবে সাইকেলটি নষ্ট থাকায় তিনি পায়ে হেঁটে বের হন। কিন্তু ওই রাতে তিনি আর বাসায় ফেরেননি। তাপস ভোর ৬টা পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বলে জানান।
পর্তুগাল দূতাবাসের নিরাপত্তাকর্মী জুলফিকার আলী বলেন, রাত সোয়া ১টার দিকে তিনি গুলির শব্দ পান। সামনে এগিয়ে দেখেন প্রায় ৫০ গজ দূরে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। এসময় সাদা রংয়ের একটি প্রাইভেট কারে ২ ব্যক্তি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা গুলি করে গাড়িতে উঠেছে। প্রাইভেট কারটি ২২/এ বিটিআই ভবনের সামনে দিয়ে চলে যায়। তিনি থানায় খবর দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নুরে আযম সাংবাদিকদের জানান, নিহত এই কূটনীতিকের বুকের বামদিকে একটি গুলি লেগেছে। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে এখনই কিছু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেছেন অপরাধ তদন্ত বিভাগের সদস্যরা। পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ঘটনাস্থলে যাওয়া সিআইডির কর্মকর্তা নুরে আলম জানান, গুলির শব্দ পেয়ে পর্তুগাল দূতাবাসের সিকিউরিটি গার্ড তালেব ও জুলফিকার এগিয়ে আসেন। তখন তারা দু’ব্যক্তিকে একটি প্রাইভেট কারে উঠে দ্রুত চলে যেতে দেখেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। হয়তো অন্য কোথাও মেরে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রাখার সময় ফাঁকা গুলি করে খুনিরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে রাস্তায় কোনো ছিনতাইকারী ওই কর্মকর্তাকে গুলি করেছে। তবে কী কারণে কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
এদিকে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে সকাল থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী ছুটে যান ইউনাইটেড হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ নিহতের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে চায়নি। এমনকি ভোর রাতে মারা গেলেও বিকাল ৪টার দিকে কড়া পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বিকালে ময়নাতদন্ত করে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মরচুয়ারিতে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক জানিয়েছেন, খালাফ আল-আলীর বুকের বাম পাশ থেকে একটি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড : পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সৌদি কর্মকর্তা খালাফ আল-আলীর হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে মনে হচ্ছে। কেননা, প্রতিদিন তিনি বাসা থেকে নৈশভ্রমণে বের হতেন—তা হয়তো খুনিদের জানা ছিল। দুর্বৃত্তরা তার কাছ থেকে কিছুই নেয়নি। ছিনতাইয়ের ঘটনা হলে তার কাছ থেকে মালামাল খোয়া যেত। অবশ্য খালাফ আল-আলী ভ্রমণে বের হওয়ার সময় কিছুই সঙ্গে নেননি। এমনকি তার মানিব্যাগ বা মোবাইল ফোনও সঙ্গে ছিল না। মনে হচ্ছে, তিনি বের হয়ে ভ্রমণ শেষে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কেননা, সাড়ে ১১টায় বাসা থেকে বের হলেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রাত সোয়া ১টার দিকে। হয়তো তিনি ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে তার বাসার অদূরে এবং পর্তুগাল দূতাবাস থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে। ওঁত্ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা বাসার কাছাকাছি আসামাত্র গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু : ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার পরিচয় পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কারও জানা ছিল না। তবে পুলিশের ভাষ্যমতে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তা থেকে উদ্ধার করে সোয়া ১টায় হাসপাতালে নিলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে তারা সাড়ে ৩টায় বুঝে পেয়েছে। প্রায় ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সৌদি কর্মকর্তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল বিনা চিকিত্সায়। তাই অবহেলার কারণে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পুলিশ সচেতন হলে এবং দায়িত্বশীল আচরণ করলে আগেই তার উন্নত চিকিত্সা শুরু করা যেত।
কারণ খতিয়ে দেখছে পুলিশ : পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিশ্চিত হতে পারেননি কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড। তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আপাতত চারটি বিষয় সামনে রেখে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রথমত, খালাফ আল-আলীকে তার নিজ বাসার ভেতরে কেউ গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে কিনা। দ্বিতীয়ত, দুর্বৃত্তরা অন্য কোথাও গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গেছে কিনা। তৃতীয়ত, নৈশভ্রমণ থেকে ফেরার পর সন্ত্রাসীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে গুলি করেছে কিনা এবং এটি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে গুলির ঘটনা কিনা। এসব বিষয় মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলা তদন্ত শুরু করছে। এ ব্যাপারে গতকাল গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় কূটনৈতিক জোনে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তা ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। র্যাব ও পুলিশ সকাল থেকেই গুলশানের কূটনৈতিক জোনে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট স্থাপন করে যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। গুলশান থানা পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় সৌদি দূতাবাসের এক নিরাপত্তাকর্মী বাদী হয়ে রাতে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ সন্দেহভাজন ক’জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন