শায়খুল হাদিস: ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান
জহির উদ্দিন বাবর
দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত অভিভাবকতুল্য আলেম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. গত ৮ আগস্ট বুধবার চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। তার এই চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। এদেশে আলেমের সংখ্যা কম নয়, তবে শায়খুল হাদিসের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও পূর্ণাঙ্গ আলেমের সংখ্যা নিতান্তই কম। দীর্ঘ ৯৪ বছরের জীবনে তিনি দেশ ও জাতিকে দিয়েছেন অগণন। কর্মের ব্যাপ্তি ও অবদানের বিশালতায় শায়খুল হাদিস ছিলেন এদেশের আলেমদের মধ্যে অনন্য-অসাধারণ। বহুমুখী পরিচয়ের যোগসূত্রতা সম্পৃক্ত হয়েছিল তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। এর ফলে তিনি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ‘শায়খুল হাদিস’ বললে একক কোনো ব্যক্তি নয়, মনে হতো এটি একটি সফল প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উপকার ভোগ করেনি এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া মুশকিল। বাংলাদেশে নিকট অতীতে এমন প্রভাবশালী, সর্বপ্লাবী ব্যক্তিত্ব ও কর্মমুখর আলেম আর অতীত হয়নি। তার ব্যক্তিত্বের বিশালতা ছুঁয়ে দেখার মতো ছিল না, বিষয়টি ছিল অনুভবের। বাংলাদেশে হাজারো ‘শায়খুল হাদিস’ থাকা সত্ত্বেও উপাধিটি তার সঙ্গে যেভাবে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়েছিল তা আর কারো ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এই উপাধির ওজন বহন করার মতো যোগ্যতা পুরোপুরি তার ছিল। ‘শায়খুল হাদিস আল্লামা’ আজকাল যে কারো নামের সঙ্গে যোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সম্মানসূচক এই উপাধিটি ‘আজিজুল হক’ নামটির সঙ্গে যেভাবে ফিট হতো কারো ক্ষেত্রে তেমনটা আর হয় না।
শুধু যোগ্যতা ও অবদানেই নয়, ব্যক্তিত্বেও তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। সারল্য ছিল তার সহজাত প্রকৃতি। তার অমায়িক ব্যবহারে সবাই ছিল মুগ্ধ। তিনি মানুষকে মূল্যায়ন করতেন এবং সম্মান দিতেন। মতের ও আদর্শের ভিন্নতা সত্ত্বেও কারো সঙ্গে তার মনোমালিন্য প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেনি। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলই ছিল তার জীবনের প্রধান মিশন। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে তিনি বেশি মূল্যায়ন করতেন আদর্শকে। আদর্শের ব্যাপারে তার কোনো আপস ছিল না। প্রতিকূল পরিবেশেও ন্যায্য কথাটি বলে দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষতার একটি ছাপ ছিল তার প্রতিটি কথা ও কাজে। ঘনিষ্ঠভাবে যারা তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তারা জানেন, সবাইকে সহজে আপন করে নেয়ার কী মহৎ গুণটি ছিল তার মধ্যে।
শায়খুল হাদিসের প্রধান অঙ্গন ছিল শিক্ষকতা। একজন আদর্শ শিক্ষকের যা গুণ হওয়া উচিত সবই ছিল তার মধ্যে। আজীবন তিনি হাদিসশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি হাদিসের পাঠদান করেছেন বেশ কয়েক বছর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় হাদিসের সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিতাব বুখারি শরিফের পাঠদান করতেন। তিনি যে মাদ্রাসায় পড়াতেন সেখানে সারা দেশের ছাত্ররা এসে ভিড় জমাতো। তার পাঠদান পদ্ধতিটি ছিল খুবই উপভোগ্য। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের জটিল জটিল বিষয় তিনি পানির মতো সহজ করে উপস্থাপন করতে পারতেন। নানা উপমা, আনুসঙ্গিক ঘটনা এবং নিজের বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতার মিশেলে তিনি পাঠদান করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার ক্লাসে বসেও ছাত্ররা বিরক্তিবোধ করতো না। জীবনের শেষ প্রান্তে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা সত্ত্বেও তিনি যখন পড়াতেন মনে হতো কোনো যুবক শিক্ষকের প্রাণবন্ত ক্লাস চলছে। তার জানার ভাণ্ডার এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, কোনো বিষয়ে তাকে ভেবেচিন্তে জবাব দিতে হতো না। প্রতিটি শাস্ত্র ছিল তার নখদর্পণে। পাঠ্যের বাইরেও ছাত্রদের জীবনচলার নানা দীক্ষা পাওয়া যেতো এই মহান শিক্ষকের কাছ থেকে। তার মতো ছাত্রপ্রাণ শিক্ষক খুব কমই আছেন। বাংলাদেশের এমন কোনো থানা-ইউনিয়ন পাওয়া যাবে না যেখানে শায়খুল হাদিসের ছাত্র বা ছাত্রের ছাত্র নেই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রিয় ছাত্রদেরই তিনি নিজের সম্পদ মনে করতেন।
শায়খুল হাদিসের জীবনের দ্বিতীয় অঙ্গন ছিল রাজনীতি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতিতে যখন নেতৃত্বের সংকট চলছিল তখন তিনি রাজনীতিতে আসেন। সে সময় তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তী সময়ে আশির দশকে হাফেজ্জি হুজুরের সঙ্গে তিনি রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ান। তিনি ছিলেন হাফেজ্জি হুজুরের একান্ত শিষ্য ও সহযোগী। এরপর খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠা করে ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ইসলামী ঐক্যজোট। নব্বইয়ের দশক পুরোটাই তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। নানা সময় তিনি ইসলাম ও দেশবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছেন। বাবরি মসজিদ অভিমুখে লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচিত ও পরিচিত হয়ে ওঠেন। মওলানা ভাসানীর পর এটাই ছিল সবচেয়ে স্মরণীয় লংমার্চ। ২০০১ সালে হাই কোর্টের রায়ে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার পর আবার গর্জে ওঠেন শায়খুল হাদিস। তার ডাকে সাড়া দিয়ে জেগে ওঠে পুরো দেশ। জেল-জুলুম, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক সেই পরিবর্তনের পেছনে শায়খুল হাদিসের ভূমিকা ছিল বিশাল। এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে শায়খুল হাদিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার স্মৃতিশক্তি যখন অনেকটাই লোপ পেয়ে যায় তখন বলয়বেষ্টিত শায়খের কোনো কোনো পদক্ষেপে কেউ কেউ সমালোচনা করেন। তবে বাস্তবতা হলো, শায়খুল হাদিস সব সময়ই রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। সজ্ঞানে তিনি জনচাহিদার বিপরীতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। কেউ তাকে ভুল বুঝিয়ে ফায়দা লুটলে সে দায় শায়খুল হাদিসের ওপর চাপানো সমীচীন হবে না।
লেখালেখি ছিল শায়খুল হাদিসের বিশেষ ব্রত। সহজ-সরল ভাষায় তিনি সবার বোধগম্য করে লেখতেন। এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় অবদান বুখারি শরিফের বঙ্গানুবাদ। কোরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ এই গ্রন্থটি তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। ১০ খণ্ডের বিশাল এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষাকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও তার লেখা বেশ কিছু বই পাঠকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তিনি নিয়মিতই লেখতেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তার লেখালেখিতে চিড় ধরতো না। আমাদের জানা মতে তিনি একটি আত্মজীবনীও লেখেছেন। এটি প্রকাশ হলে সবাই উপকৃত হতে পারবে। তার বয়ান-বক্তৃতার সংকলনও বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বিশাল সম্পদ। আরবি কাব্যেও ছিল তার বিশেষ দখল। প্রিয়নবির শানে তার নিজের লেখা আরবি কবিতা তিনি নিজেই যখন আবৃত্তি করতেন তখন তা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিতো।
এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অভিভাবক ছিলেন শায়খুল হাদিস। অমীমাংসিত ধর্মীয় ইস্যুগুলোতে সবাই তার শরণাপন্ন হতো। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার এই মনীষী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এসবের মীমাংসা করতেন। দেশের শত শত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো তার পরামর্শে। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি সেখানে ছুটে যেতেন নিঃস্বার্থভাবে। বিশেষত আলেম-ওলামাদের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল জোরালো। বিভিন্ন সময় সারা দেশের আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তার সমকালীন আলেম-ওলামারাও তাকে নেতৃত্বের আসনে বসাতেন। তার মতো অবিসংবাদিত নেতৃত্ব আলেমদের মধ্যে খুব কমই গড়ে ওঠে। শত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও আলেমরা তাকে আশ্রয়স্থল মনে করতেন। তার এই চলে যাওয়ায় বিশেষভাবে দেশের আলেমসমাজ নেতৃত্ব ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়লো। অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় এদেশের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় অঙ্গনে সরব উপস্থিতি ছিল শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর। কর্মমুখর ও বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি দেশ ও জাতির জন্য যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন এর সুস্পষ্ট ছাপ অনুভব করা যাবে আরো কয়েক শতাব্দি পর্যন্ত। কর্ম ও অবদানের এই ছাপই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে শায়খুল হাদিসের অগণিত শিষ্য-ভক্ত ও অনুরাগীদের। এর মধ্য দিয়েই তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন