বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

সংখ্যালঘুদের চিন্তা-চেতনা সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা

অলিউল্লাহ নোমান, যুক্তরাজ্য থেকে শাহবাগ চত্বরের তথাকথিত প্রজন্ম চত্বরের ডা. ইমরান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। শাহবাগ চত্বরের নষ্টামি নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ইমরান এই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। হঠাত্ করে সরকারি তত্ত্বাবধানে গজিয়ে ওঠা ডা. ইমরান এটা বলতেই পারেন। তিন স্তরের পুলিশি নিরাপত্তার বেষ্টনীতে গজিয়ে ওঠা এই নেতা নিজেকে এখন বিশাল কিছু মনে করছেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী কোর্ট রায় দেয় (আল্লামা সাঈদীর রায়ের আগের দিন বিকালে ইমরান শাহবাগে ঘোষণা করেছিলেন, আগামীকাল ফাঁসির আদেশ নিয়ে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরব), পার্লামেন্টে আইন পাস হয়। কথায় কথায় তিনি নিজেকে ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। সুতরাং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও তার সঙ্গে এবং তার কথায় চলার জন্য বলতে দ্বিধা না করারই কথা। এই হুশিয়ারির ধৃষ্টতা তিনি দেখাতেই পারেন। আর একটি প্রশ্ন অনেকেই করেন, সেটা হলো কথায় কথায় যারা নিজেকে ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি মনে করে তাদের আবার তিন স্তরের নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় কেন! শাহবাগ চত্বরে তথাকথিত তরুণ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা রাতের অন্ধকারে কী করেছেন সেটা এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই না। অনেক কিছুই সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো ভদ্র ঘরের তরুণ-তরুণী এভাবে খোলা আকাশের নিচে একসঙ্গে রাতযাপন করবেন না বা করার কথাও নয়। ইমরানের দাবি অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতা এই তথাকথিত প্রজন্মের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন কিনা সেটা তিনিই ভালো বোঝেন। তবে আমি এখানে যেটা বলতে চাচ্ছি, বিরোধীদলীয় নেতা দেশনেত্রী খালেদা জিয়া শাহবাগ নিয়ে সর্বশেষ যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই যথার্থ। তিনি মানিকগঞ্জের সর্বশেষ বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। বিচার বিএনপিও করবে। তবে সেটা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে—এ বিষয়টি তিনি বলেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও বিচার হবে সেটা তিনি স্পষ্ট করেছন। যারা বর্তমানে গণহত্যা চালাচ্ছে তাদের বিচারও ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধী নেত্রী। তার এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে বিরোধী দলের অবস্থান পরিষ্কার হয়েছে জাতির সামনে। শুধু তাই নয়, ২৮ ফেব্রুয়ারির গণহত্যার পর সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছে দলীয় নেতাকর্মীদের সংবর্ধনা নেননি। বরং এসব বিষয়ে শক্ত অবস্থানের ঘোষণা দেন। গণহত্যার প্রতিবাদে হরতালের ডাক দেন। তার চিরাচরিত আপসহীন মনোভাব প্রকাশ করেন জাতির সামনে। এতেই শাহবাগিদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। যারা বিরিয়ানি বিতরণ করে, টাকা সরবরাহ করে শাহবাগ চত্বরকে সরগরম রাখতে চেয়েছিল তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে বিরোধীদলীয় নেতার ঘোষণায়। অনেকেই আবোল-তাবোল বলছেন বিরোধীদলীয় নেতার ঘোষণা নিয়ে। তবে এটা পরিষ্কার, ২৮ ফেব্রুয়ারির গণহত্যার পর সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে বিরোধীদলীয় নেতার ঘোষণায় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী মানুষের মনে আশার আলো জেগেছে। মানুষ তাকিয়ে ছিল বিরোধীদলীয় নেতার মুখের দিকে। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে কী ঘোষণা দেবেন সেটা জানার জন্য। গত কয়েকদিন যার সঙ্গেই কথা হয়েছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থানের প্রশংসা করছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হরতাল চলাকালে দেখা করতে যাননি বিরোধীদলীয় নেতা। নিরাপত্তার কারণে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ বাতিল করেন। তবে এটা ঠিক, ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ প্রতিদিন সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের নাগরিকদের খুন করছে। নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছেন ভারতীয় বাহিনীর বুলেটের আঘাতে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের নাগরিকদের। নির্যাতন করছে উলঙ্গ করে। ভারত তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে আমাদের পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বার বার ভারতের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন সীমান্তে আর গুলি চালানো হবে না। চার বছর পার হয়ে গেলেও তিস্তা সমস্যা সমাধান করতে পারছে না বর্তমান সরকার। যদিও ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বার বার ওয়াদা করা সত্ত্বেও ভারত এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এসব প্রেক্ষিতেও ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার সাক্ষাত্ না করাটা যথার্থ হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর যে মুহূর্তে সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে, সেই মুহূর্তে ভারতের রাষ্ট্রপতির সফর নিয়ে খোদ ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অথচ সেই ভারতকে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। তিতাস নদী হত্যা করে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতীয় যান চলাচলের সুবিধা করে দিয়েছে সরকার। ২০১১ সালে ভারতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী চুক্তি করে এসেছিলেন সেটা আজও প্রকাশ করা হয়নি। জাতিকে জানানো হয়নি ভারতের সঙ্গে চুক্তিগুলোর বিষয়ে। উল্টো ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। শাহবাগে হঠাত্ গজিয়ে ওঠা তথাকথিত প্রজন্মের তরুণদের আন্দোলনে ভারতের ইন্ধন রয়েছে। এ বিষয়ে ভারতীয় পত্রিকাগুলোর রিপোর্ট এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন হয়েছে ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশী তরুণদের ভিসা দিতেও শাহবাগে যাওয়ার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এতেই স্পষ্ট, শাহবাগে জমায়েত হওয়া তথাকথিত তরুণদের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে কী ঘটাতে চেয়েছিল। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই শাহবাগের এই উন্মাদনাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায় তারা। আর তাদের এই উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য কতগুলো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। এই ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর চোখে শাহবাগি তরুণরা ছাড়া আর কেউ মানুষ বা জনতা নয়। শাহবাগি তরুণরা ছাড়া বাকি হাজারো মানুষ একত্রিত হলেও জনতার কাতারে পড়ে না। কারণ যারা আল্লাহ ও নবী-রাসুলে বিশ্বাস করেন তারা জনতার কাতারে পড়তে পারে না। তারা হয় রাজাকার না হলে জঙ্গি। এটাই হলো এসব মিডিয়ার বর্ণনা। এই ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে ‘প্রথম আলো’। শুধু গত শনিবারের অনলাইনে লন্ডন সময় বিকাল ৫টার একটি চিত্র। শাহবাগি তরুণদের নিয়েই প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি নিউজ। একটি নিউজের শিরোনাম ছিল : ‘শাহবাগ নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি’ এটা ডা. ইমরানের বক্তব্য। একই পৃষ্ঠায় ডা. ইমরানের আরও একটি বক্তব্য হলো, খালেদা জিয়ার উদ্দেশে, ‘নষ্ট তরুণ নাকি খুনি ধর্ষকের পাশে দাঁড়াবেন?’ আরেকটি সংবাদের শিরোনাম হলো : ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহাসম্মেলনে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’। এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হলেন ড. আনিসুজ্জামান, সুলতানা কামাল চক্রবর্তী গং। সেদিনই খালেদা জিয়ার মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর সফরের বিষয়ে আরেকটি সংবাদের বর্ণনায় বলা হয়, ‘২৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ডাকা হরতালে সিঙ্গাইরের গোবিন্দল এলাকায় হরতালের সমর্থক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ গ্রামবাসী নিহত হয়।’ অথচ সেদিন হরতালের সমর্থনে গ্রামের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাদের ওপর আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী ও পুলিশ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিরস্ত্র এসব প্রতিবাদী মানুষকে তারা খুন করেছে বন্দুকের গুলি দিয়ে। প্রথম আলোর বর্ণনা অনুযায়ী হরতালের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা আওয়ামী গুণ্ডারা হলো এলাকাবাসী বা গ্রামবাসী। আর হরতালের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসা হাজারো মানুষকে তারা গ্রাম বা এলাকার হিসেবে গণ্য করেন না। হরতালে সাধারণ নাগরিকদের ওপর পুলিশ বন্দুক নিয়ে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এসব তাদের চোখে তেমন একটা ধরা পড়ে না। বরং উল্টো তারা হরতালের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসা সাধারণ মানুষকে সহিংস বলে কেতাবি ভাষায় আক্রমণ করে। এ পর্যন্ত কোনো হরতাল বা প্রতিবাদে কেউ অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামেনি। কোনো পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ ধরনের কোনো ছবি বা ফুটেজ দেখাতে পারবে না। কিন্তু তারপরও এসব প্রতিবাদী মানুষ হলো সহিংস! নিরস্ত্র মানুষদের যখন গুলি করে মারা হয়, মিডিয়াগুলোতে বলা হয় সহিংসতায় নিহত হয়েছে। হরতালকারী বা প্রতিবাদীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয়েছে বলতে তাদের লজ্জা লাগে। বর্তমান এ অবস্থায় একটা জিনিস জাতির সামনে একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মিডিয়া সংখ্যালঘু, নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষীদের চিন্তা-চেতনা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কৃষ্টির পরিবর্তে একটি বিজাতীয় কৃষ্টি চাপিয়ে দিতে চায় তারা। এজন্যই একটি ধর্মের সংস্কৃতি মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান করাকে তারা ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে কৌশলী প্রচার চালাচ্ছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে ইসলাম। তারা এক আল্লাহ, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ও অন্য নবীদের ওপর আস্থায়ও বিশ্বাসী। এখনও মুসলমান পরিবারে সন্তান জন্ম নিলে প্রথমেই কানে আল্লাহু আকবার বলা হয়। প্রতিটি গ্রামের মক্তবে এখনও শেখা হয় পরস্পরের মধ্যে সালাম বিনিময় কীভাবে করতে হবে। মুরুব্বিদের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার রেওয়াজ মক্তব থেকে শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের মিডিয়াগুলো সালামের পরিবর্তে শুভ সন্ধ্যা, শুভ দুপুর, শুভ সকাল বা শুভ রাত্রি বলে শেখানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। নাটকে যত রকমের খারাপ চরিত্র রয়েছে সেগুলোতে দাড়ি-টুপিওয়ালা লোক দেখানোর চেষ্টা করা হয়। আর এদেরই বংশধর হলো শাহবাগের প্রজন্ম। শাহবাগের হোতা ডা. ইমরান সরকার কথায় কথায় ১৬ কোটি লোকের দোহাই দেন। আমি বলতে চাই, আপনাদের চিন্তা-চেতনা ও ৬ দফা দাবি নিয়ে গণভোট করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। আমি সেই অনুরোধ রাখছি আপনার কাছে। কারণ আপনাদের দাবি অনুযায়ী আদালতে রায় হয়, সংসদে আইন পাস হয়। সুতরাং আপনারাই সেই দাবিটি উচ্চারণ করলে সরকার গণভোটের আয়োজন করতে পারে। তখন হয়তো দেখা যাবে ১৬ কোটি মানুষের কতজন আপনাদের সমর্থন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কার পক্ষে রায় দেয় তখন দেখা যাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায় ছাড়া কতিপয় খুনি, ধর্ষণে সেঞ্চুরিকারী অস্ত্রবাজ ছাত্রলীগ, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পর লাশের ওপর নৃত্যকারী স্বঘোষিত খুনিদের সঙ্গে নিয়ে ৩ স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ অবস্থায় থেকে ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন