মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বিতর্ক
ফরহাদ মজহার
সম্প্রতি দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ২৮ জানুয়ারি তারিখে ‘চলমান জাতীয় সঙ্কট: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক একটি সভা করেছেন। সেই সভায় বিচারপতি আবদুর রউফ, খোন্দকার মাহবুব হোসেন, লে. ক. (অব:) মোহাম্মদ সেলিম, রুহুল আলম গাজীসহ আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তার জন্য তাঁকে ও সভার উদ্যোক্তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর অনেকেই দেখেছেন।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও সমাধান অন্বেষণ অবশ্যই ইতিবাচক। সভায় ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করা হবে তা আমি আগে জানতাম না এবং আমার সঙ্গে আগে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয় নি। ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া কারা এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাও জানি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল এবং সমাধানের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ আগের যেকোনো পরিস্থিতির তুলনায় কঠিন। এই ধরনের সংবেদনশীল সময়ে কোনো প্রস্তাব পেশ করার আগে তা নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা দরকার এবং বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হলেও কখন কিভাবে কোন ভাষায় তা হাজির করতে হবে সেই বিষয়েও বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি।
এটা ঠিক যে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ কথাটি নামকরণের দিক থেকে আওয়ামী লীগের পুরানা রাজনীতির অনুরণন, এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মার্কা ‘জাতীয় ঐকমত্য’কে প্রাধান্য দিয়েই নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননকে নিয়ে বর্তমানে যে সরকার রয়েছে সেটা জাতীয় ঐক্যের আওয়ামী ধারণা অনুযায়ী ‘ঐকমত্য’-এর সরকারই বটে। প্রফেসর এমাজউদ্দীন আগামী দিনের জন্য এই ধরনের একটি সরকারের অধিক কিছু ভাবতে পারছেন কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর লেখালিখির মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি। সে যা-ই হোক, সম্প্রতি তিনি শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়ে নির্বাচন হতে তো সমস্যা নেই’।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতি কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার মতো নয়। শ্রীলঙ্কায় হয়েছে বলে বাংলাদেশেই সেটা সম্ভব এটা ভাবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু তারপরও তিনি চাইছেন শেখ হাসিনার অধীনেই একটা নির্বাচন হোক। এ কথা বলার অর্থ শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করে বিশ দলীয় জোট ভুল করেছে! এখন তা সংশোধন করতে হবে। তাই কি?
তাঁর হঠাৎ আন্দোলনের মাঝখানে এ কথা বলার অর্থ কি? আগামী দিনে শেখ হাসিনার সরকারে যেভাবে এরশাদ, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন আছে তেমনি কি তিনি বিএনপির নেতাদেরও যোগদান চান? তাঁর কাছে সম্ভবত রওশন এরশাদের অধিক মর্যাদা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাই। তিনি কি চান রওশন এরশাদের মতোই খালেদা জিয়া হাসিনার সরকারে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসাবে যোগদান করুক? বিরোধী দলের আন্দোলনে যারা অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন ও বুকে গুলি নিয়ে শহীদ কিম্বা পঙ্গু হচ্ছেন, আগুনে পুড়ে মরছেন- সেই সকল নেতাকর্মীর কাছে এই ধরনের প্রস্তাব চরম অবমাননাকর বলে গণ্য হতে পারে। এই দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করবার কথা বলা ঠিক হয় নি।
তারপরও বলব ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ যা সঠিক মনে করেন তা বলার অধিকার তাঁর আছে এবং তাঁর কিম্বা অন্য যে-কারো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাতে আমার কোনোই আপত্তি নাই। তবে ২৮ তারিখে সভায় যখন ঘোষণা করা হলো যে এই প্রস্তাবে আমি স্বাক্ষর করেছি, তখন মঞ্চ থেকেই আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জানাতে হয়েছে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির কোনো দৃশ্যমান পরিণতি বিচার না করে এই ধরনের কোন প্রস্তাব আন্দোলন-সংগ্রামের বর্তমান চলমান মুহূর্তে আমি সমর্থন করি না, স্বাক্ষর করার প্রশ্নই আসে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো যেমন আছে তেমনি অক্ষত রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক পরে হাত থেকে আরেকটি পরে হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আমার রাজনীতি না। এই রাজনীতি আমি করি না। সাত দফার সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করবার ক্ষেত্রে বিরোধী জোটের আন্দোলনে ও কৌশলে ব্যর্থতা থাকতে পারে কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন চায়। অতএব আমাদের কাজ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে বিকশিত হতে পারে তার প্রতি মনোযোগী হওয়া। নির্বাচন তো হতেই হবে। সেটা কখন কিভাবে কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা আন্দোলনের সাফল্য বা পরিণতির ওপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন।
এরপরও কালের কণ্ঠ পত্রিকায় একটি খবর দেখে আমি অবাক হয়েছি। ‘শত নাগরিক’ নামক সংগঠনটির জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসাবে কবি আবদুল হাই শিকদার স্বাক্ষরিত সংবাদের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে ড. এমাজউদ্দীন আহমদের প্রস্তাবে যারা ‘একমত পোষণ করেছেন’ তাদের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আমার নাম দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! ফলে আমাকে আবারও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। আমি সুস্পষ্ট ভাবে সকলকে জানিয়ে দিতে চাই এই ধরনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি কখনই কোনো কালে ‘শত নাগরিক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না বা যুক্ত নই। (দেখুন, ‘এমাজউদ্দীনের প্রস্তাবে শত নাগরিকের সমর্থন’)
যেখানে চলমান সঙ্কট নিরসন দূরে থাকুক, তাকে আরো তিক্ত, কুৎসিত ও হিংস্রপর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য খালেদা জিয়ার বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হচ্ছে, তাকে না খেয়ে মারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ডিশ লাইন, ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করা হচ্ছে- সেই সময় শত নাগরিকদের উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাস্তায় নেমে আসা, প্রতিবাদ করা এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও নানাবিধ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। কিন্তু সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে অনেককেই এখন দেখছি আওয়ামী লীগের অনুকরণ কিম্বা অনুরণনে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় ঐকমত্য সরকার’ গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করছেন।
বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের কথা ও কাজে নিরন্তর নগ্ন ও কুৎসিত আক্রমণের মুখে ন্যূনতম প্রতিবাদে না গিয়ে উলটা সেই সরকারকে সাথে নিয়েই কি তারা ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের’ প্রস্তাব করছেন? কেন করছেন আমি জানি না। এই আবেদন নিবেদনের অর্থ কি তা আমি বুঝতে অম। ফলে আমার রাজনীতির সাথে ক্ষক্ষমতাসীনদের কাছে এই অবাস্তব আবেদন নিবেদনের কোন মিল আমি খুঁজে পাই নাই। চলতি রাজনৈতিক ক্রাইসিসে এটা কোন বাস্তবোচিত প্রস্তাব নয়। তাই আমি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই, যদি তা-ই হয়, তাহলে আমি তাদের সাথে একমত নই।
দুই.
‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ ধারণা যদি ক্ষক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে আসত তাতে হয়তো কিছু আবেদন থাকত। এটা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আসায় আমি মনে করি এই মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে এই দাবি বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করতে পারে। দেশকে আরো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রস্তাব সাধারণ জনগণ বিশেষত যারা আন্দোলন সংগ্রামে জীবন দিচ্ছেন তাদের কাছে ষড়যন্ত্র গণ্য করবার কারণ হতে পারে। আশা করি, যারা তার প্রস্তাব করছেন তারা এসব বিবেচনায় নেবেন।
শেখ হাসিনা তো নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদি এটাই এখন চাই তাহলে তখন সেই প্রস্তাব লুফে নেওয়া হলো না কেন? যারা ক্ষমতাসীন রয়েছেন তাদের সমর্থনের বাইরে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ধরনের কোন অন্তর্র্বতী সরকার যদি আদৌ রাজনৈতিক কারণে গঠন জরুরি হয়ে পড়ে তাহলে ক্ষমতাবানরাই সেটা গঠন করে, তাহলে এখন এই ধরনের সরকার গঠনের শক্তির ভিত্তি কি? কারা এই সরকার গঠন করতে চাইছে? এটা কি আন্দোলন-সংগ্রামে বিজয়ী রাজনৈতিক পক্ষে নাকি ক্ষমতাসীন সরকার সদাশয় হয়ে এই ধরনের সরকার কবুল করবেন?
এই ধরনের প্রস্তাবের রাজনীতিকরণ না ঘটিয়ে অর্থাৎ এখনই সমাধানের প্রস্তাব হিসাবে পেশ না করে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিভাবে নতুন অন্তর্র্বতী ক্ষমতা তৈরি হয়, কিম্বা বিদ্যমান বাস্তবতা বিচার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সেটা তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সতর্ক প্রজ্ঞার কাজ। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো শুরুতেই উঠে আসে সেটা হোল কারা এই সরকার গঠন করবে? জাতীয় ঐকমত্যের সরকার তো বললেই গঠিত হয়ে যাবে না, বা চাইলেই গঠন করা যায় না; এর সঙ্গে সরাসরি ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত। সেই ক্ষমতা তৈরি হবে কিভাবে? কিম্বা সেই ক্ষমতা হাজির থাকলে সেটা কোথায় কিম্বা কারা? যারা ক্ষমতায় আছেন এবং ক্ষমতাবান তারা এই ধরনের সরকার চাইবেনই বা কেন? কিম্বা এই ধরনের সরকার গঠন করবার ক্ষমতা যাদের আছে তারা আদৌ এই ধরনের সরকার গঠনে শক্তি জোগাবে কি? যদি ক্ষমতাসীনেরা এই ধরনের সরকারে সমর্থন না দেয় অর্থাৎ যদি এই সরকার শেখ হাসিনার অধীন রওশন এরশাদ-ইনু-মেনন জাতীয় না হয় তাহলে এর পেছনের অনুমানটি কী? সেটা কি এই যে এর সমর্থন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, কিম্বা বিদেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আসতে হবে। অতীতে আমরা এমন দেখেনি যে তা নয়, কিন্তু তা সবসময়ই জনগণের স্বার্থের বদলে বিদেশী স্বার্থ রার নির্দেশ পালনের বিপদে আমাদের নিক্ষিপ্ত করেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিকশিত না করে এবং জনগণের ওপর আস্থা না রেখে রাষ্ট্রের সশস্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিম্বা বিদেশী কোনো পরাশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো বিচক্ষণ কিম্বা আদর্শ রাজনীতি নয়।
কিন্তু তার পরেও বলা যায় বর্তমান জাতীয় সঙ্কট থেকে বেরোতে হলে একটা অন্তর্র্বতীকালীন সরকার রাজনৈতিক ভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু রাজনৈতিক মীমাংসার তর্ককে শুধু আইনি ও সাংবিধানিক তর্ক হিসাবে দেখা ও দেখাবার জন্য আইন পেশার অনেককেই অতি উৎসাহিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। যেমন এখন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বৈধতা কী নিয়ে তা নিয়ে তারা বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা এখনো বুঝতে পারেন না বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো কন্সটিউটিউশনাল বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সাই সকল ক্ষমতা এবং তার বৈধতার উৎস, উকিলদের ওকালতি নয়, কিম্বা কোনো সংবিধানও নয়। উকিল মোক্তারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে প্রায়ই প্রকট রাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করে।
সংবিধানের বাইরে জনগণের ক্ষমতার ধারণা ও তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের নাই তা নয়। একাত্তর তো বটেই। এমনকি সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতাচ্যুতি কোনোটিই সাংবিধানিক ভাবে হয় নি। ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা অর্থাৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতই তাকে তাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে পরে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার সম্ভাবনা তখন দেখা দিয়েছিল। তাকে নস্যাৎ করে দিয়েই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রার নামে পুরানা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যার কুফল আমরা এখন হাড়ে হাড়ে ভোগ করছি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার হিসাবে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’-এর প্রস্তাব কোন পরিণত বিবেচনা থেকে পেশ করা হয় নি। রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা কথাটা প্রচলিত হলেও তার মানে আসলে কী সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা আমাদের সমাজে হয় নি। গণ-আন্দোলন ও রাজনীতিই একাত্তর কিম্বা সাতই নভেম্বরের মতো নির্ধারণ করে দেবে যে জনগণ কিভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা করবে। এটা আইনি বা সাংবিধানিক ব্যাপার মাত্র নয়। কোনো প্রস্তাব দিয়ে নয়, বরং সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেই মুহূর্ত আদায় করে নিতে হয়। ইতিহাস সেই স্যাই বারবার দেয়।
তবে এত কিছুর পরেও অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের প্রস্তাবের ইতিবাচক দিক হচ্ছে নির্বাচনকেই সমাধান গণ্য করলেও বর্তমান সঙ্কটের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার দিকটা তিনি নজরে এনেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বন্ধ করে দিয়েছে। সংশোধনীতে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি এটা বদলাতে চান এবং যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত সেই সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কারও করতে চান। কিন্তু বর্তমান সংবিধান মানবিক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করেছে এবং একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে সেই বিষয়ে তিনি নীরব। তিনি ততটুকুই সংস্কার চান যতটুকু নির্বাচনের জন্য দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান জরুরি সেই প্রয়োজনীয়তার কোনো ইঙ্গিতই তিনি দেন নি।
নির্বাচনের জন্য সংবিধানের সংস্কার বর্তমান সংবিধান রুদ্ধ করেছে, এটা তিনি ঠিক বলেছেন। যদি সংবিধান দিয়ে সংবিধান তিনি সংশোধন করতে চান তাহলে সেটা কি তিনি ক্ষমতাসীনদের দিয়ে করাবেন? সেটা হবে তাঁর ভাষায় বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা। অথচ সেটা সম্ভব নয় সেটাও তিনি জানেন। তাহলে সংবিধানের সংস্কার করতে হবে অসাংবিধানিক ভাবে। তাঁর ভাষায় ‘সংবিধান সংশোধন না করে’ করা। সেটা কেমন? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই মহৎ কর্ম নাকি করবেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সংবিধানে প্রেসিডেন্টের তো সেই ক্ষমতা নাই। তবুও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবেন। পরর্র্বতীকালে যে সংসদ গঠিত হবে ওই সংসদ প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশকে অনুমোদন দেবে। কায়দাটা পুরানা। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা বদলাও, তারপর সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘অবৈধ’ কাজ বৈধ করে নাও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট অসাংবিধানিক ভাবে সংবিধান বদলাতে চাইলে তাঁকে তা করতে দেবে কে? তার কোনো উত্তর আমার জানা নাই। শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের তা জানা থাকলে তিনি আশা করি আমাদের জানাবেন। যদি জনগণের ইচ্ছা ও সঙ্কল্পই ক্ষমতার উৎস ও বৈধতা হয়, তাহলে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে বৈধতা নিতে এত সাংবিধানিক ক্যারিকেচারের কী দরকার? (দেখুন, ‘প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে পারেন’, মানবজমিন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
তিন.
আমার বিভিন্ন লেখায় আমি বারবার বলেছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নির্বাচনে না, সেটা রাষ্ট্রগঠনের গোড়ায় নিহিত। একাত্তরে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে এই ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুদ্ধ করেছি ও জীবন দিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণায় যা সুস্পষ্ট ভাবে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়েছে। এই ইতিহাস অস্বীকার করবার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু স্বাধীনতার এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে একটি দলের আদর্শ ও কর্মসূচিকে বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশ বিভক্ত হয়েছে, সমাজ বিভক্ত হয়েছে আজ আমরা পরস্পরকে নির্মূল করতে উদ্যত। এই বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতায় আজ পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। তার সাংবিধানিক, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি আছে। যে ফ্যাসিবাদ দেশে কায়েম হয়েছে তার সমাধান ফল চলতি কনস্টিটিউশনের মধ্যে নাই। ফলে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা জনগণকে ভাবতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা বাংলাদেশকে বিভক্ত, রক্তাক্ত, হানাহানি, হত্যা, গুম ও সহিংস দলবাজির ক্ষেত্রে পরিণত করেছে- তাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জনগণের লড়াই ছাড়া কোনো স্থিতিশীল রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ গঠন অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। সাধারণ মানুষ বারবার প্রাণ দিতে থাকবে এবং তার ফল নেবে দুই পরে লুটেরা দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ বিভিন্ন গোষ্ঠি। নিজ কোটারি স্বার্থের জন্য যারা হেন কোনো হীন কাজ নাই যা করে না বা করতে পারে না। এই ভাবে দেশ চলতে পারে না।
যারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত তারা যেন বিভ্রান্ত না হন তার জন্য আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে একমত হওয়া তো দূরের কথা আমার কোনো দূরবর্তী সংশ্রবও নাই। এ ধরনের প্রস্তাব চলতি সঙ্কট মেটাতে কাজে আসবে না। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অধ্যাদেশ জারির কথা এমনকি নতুন অন্তর্র্বতী ক্ষমতা তৈরি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে সংলাপ শুরুর প্রস্তাবও হতে পারে কি না সে ব্যাপারেও আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। রাজনীতির পক্ষগুলো যদি আদৌ কোনো রাজনৈতিক সমাধান চায় তাহলে প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেই আসতে হবে।
ফরহাদ মজহার: কবি: কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : ভধৎযধফসধুযধৎ@যড়ঃসধরষ.পড়স
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন