রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

নাস্তিকতার আবরণে ইসলামবিদ্বেষ

মাহমুদুর রহমান আমাদের ছাত্রজীবনে কেউ নাস্তিক শুনলে তার দিকে কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাতাম। মনে হতো ভিন গ্রহের বাসিন্দা বুঝি। তখন ডিজিটাল যুগ আসেনি, পত্রিকায় লিখেও কেউ তার নাস্তিকতার সবিস্তার জানান দিতেন না। সবকিছুই ছিল লোকমুখে শোনা। মাত্র গুটিকয়েক বিখ্যাত নাস্তিক ছিলেন। মুসলমান পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক ড. আহমদ শরীফ এবং জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের কথাই আমাদের ছাত্রজীবনের আড্ডায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতো। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম কেন, কোনো ধর্ম নিয়েই অযথা নিন্দা করতেন বলে শুনিনি, আজকের তরুণ নাস্তিকদের মতো অশ্লীল বাক্য ব্যবহার তো দূরের কথা। তরুণ বয়সে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের মধ্যেও যে এক ধরনের নির্বিকার মনোভাব ছিল না, এমন দাবি করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। লেনিন বলেছেন, ধর্ম নাকি আফিম—এসব কথা নিয়ে তুমুল তর্ক বেধে যেত। ইসলামের ইতিহাস চর্চার চেয়ে সেই বয়সে বিপ্লবী চে-গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন কাহিনী পড়তেই বরঞ্চ বেশি উত্সাহ পেতাম। তবে, যে যতই বাম ঘরানার হোক না কেন, আমাদের মহানবী (সা.) সম্পর্কে ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধাপোষণ করত না, এমন কোনো সহপাঠী কিংবা পাড়াতুতো বন্ধুর অস্তিত্ব ছিল না। শাহবাগের দুর্বিনীত, ইসলাম-বিদ্বেষী, বেপরোয়া ব্লগারচক্র সরকারের প্রকাশ্য মদতে ১৭ দিনব্যাপী একটানা নাটক মঞ্চস্থ করে দৃশ্যপট থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে বটে; কিন্তু যাওয়ার আগে বাংলাদেশের বর্তমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধ সম্পর্কে আমার আস্থায় বড়সড় ফাটল তৈরি করে দিয়ে গেছে। নাস্তিকতা বা অঃযবরংস শব্দটি গ্রিক ভাষার ধঃযবড়ং থেকে এসেছে। এর অর্থ—ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা (ঘড়হ-বীরংঃবহপব ড়ত্ রিঃযড়ঁঃ এড়ফ)। ইউরোপ ও এশিয়ায় দার্শনিক আলোচনায় এই তত্ত্বের উত্পত্তিকাল যদিও খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধারণা করা হয়, কিন্তু পশ্চিমে আধুনিককালে আঠারো শতকেই এর সর্বাধিক বিস্তারলাভ ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানের অনেক পণ্ডিত ধারণা করেন যে প্রধানত মূর্তিপূজার বিরুদ্ধেই এথিজমের দার্শনিকতার উত্পত্তি। বাংলাদেশের নাস্তিকরা অবশ্য মূর্তিপূজার প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে ইসলামকেই একমাত্র প্রতিপ বানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বপ্রথম এথিজম গ্রহণ করা হলেও ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পর ১৭৯৩ সালে ঈঁষঃ ড়ভ জবধংড়হ নামে নাস্তিক্যবাদী আইন স্বল্প সময়ের জন্য জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঋত্ধহপব গ্রহণ করেছিল। সে বছর ১০ নভেম্বর বিলটি গৃহীত হলেও মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ১৭৯৪ সালের ৭ মে সেটি বাতিল করে ধর্মভিত্তিক ঈঁষঃ ড়ভ ঃযব ঝঁঢ়ত্বসব ইবরহম গ্রহণ করা হয়। আশা করি, পাঠক এথিজম এর সঙ্গে সেক্যুলারিজমকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সেক্যুলারিজম আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের বিষয়-বহির্ভূত বিধায় ভবিষ্যতে অন্য কোনো লেখায় এ বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে। পৃথিবীতে এথিস্টদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ২০১২ সালে ডওঘ/এওঅ পরিচালিত সমীায় ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নিজেদেরকে এথিস্টরূপে পরিচয় দিয়েছেন। আবার অন্য এক সমীায় ২.৩ শতাংশ এথিস্ট এবং ১১.৯ শতাংশ ধর্মহীন (ঘড়হ-ত্বষরমরড়ঁং) মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব সমীা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে এথিস্টদের সংখ্যা নিম্নরূপ : ফ্রান্স ৩২% জার্মানি ২০% গ্রেট ব্রিটেন ১৭% স্পেন ১১% ইটালি ৭% যুক্তরাষ্ট্র ৪% আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রকে যতই বাধা-বন্ধনহীন সমাজ মনে করুক না কেন, সমীা বলছে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিটি ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট রণশীল। বাংলাদেশের সমাজে নাস্তিকতা কতখানি বিস্তার লাভ করেছে, তার কোনো সমীা কোথাও পাওয়া সম্ভব বলে আমার অন্তত জানা নেই। কেউ এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে উপকৃত হব। তবে এদের সংখ্যা নিয়ে আমি মোটেও উদ্বেগ পোষণ করি না। কেউ যদি আল্লাহ, ঈশ্বরে কিংবা ভগবানে বিশ্বাস করতে না চায়, সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। শাহবাগ পিকনিক দেখার পর এদেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার জায়গাটা অন্যত্র তৈরি হয়েছে। সে বিষয়ে লেখার আগে আমাদের প্রজন্মের বাল্য, কৈশোর ও প্রাকযৌবনকাল নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করছি। আগের অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে, আমার বাল্যকাল কেটেছে পুরনো ঢাকার নানার বাড়িতে। তিনি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি করতেন। প্রতিদিন সকালে কিন শেভ্ড হয়ে অফিসে যেতেন। পোশাক-আশাকে যথেষ্ট সৌখিন ছিলেন। হৃদরোগ ধরা না পড়া পর্যন্ত ধূমপানের প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। বলতে গেলে চেইন স্মোকারই ছিলেন। নানার বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল। গেন্ডারিয়াতে সীমান্ত গ্রন্থাগার নামে একটি লাইব্রেরি ছিল। সদস্যরা মাসিক চাঁদার বিনিময়ে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তেন। আমার দায়িত্ব ছিল নানার জন্য সপ্তাহে অন্তত দুটি গল্পের বই নিয়ে যাওয়া। আমার পড়াশোনার নেশাও সীমান্ত গ্রন্থাগারে সেই বই ঘাঁটাঘাঁটি থেকেই। আমার যথেষ্ট স্মার্ট সেই নানাকে জ্ঞান হওয়া অবধি কোনোদিন নামাজ রোজা কাজা করতে দেখিনি। তিনি আরবি ভাষায় তেমন দ ছিলেন না। বরং আমার নানী কোরআনে হাফেজ ছিলেন। নানার ভুল উচ্চারণে সুরা পাঠ নিয়ে নানী প্রায়ই ঠাট্টা-তামাশা করতেন। কোরআন তেলাওয়াতে ভুল-শুদ্ধ বোঝার মতো বিদ্যা আমার ছিল না। তবে প্রতি সুবেহ্ সাদেকে আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে শোনা নানার নামাজ পড়ার শব্দ এখনও কানে বাজে। তিনি ধার্মিক, উদার ও নীতিবান মানুষ ছিলেন। আমাদের বাসার কাছে দুটি মসজিদ ছিল। কিন্তু একটা মসজিদে নানা কখনও নামাজ পড়তে যেতেন না। কারণ, যে জমির ওপর মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল, তার একটি অংশ নাকি একজন হিন্দু বিধবার ছিল। সম্ভবত তার কাছ থেকে জমি নেয়ার সময় উপযুক্ত দাম দেয়া হয়নি। নানা বলতেন, ওখানে নামাজ পড়লে নাকি শুদ্ধ হবে না। ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আমার এক শিক সপরিবারে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। যাই হোক, নানার শাসন খুব কড়া ছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে সূর্যাস্তের আগে বাড়িতে ফেরার কঠোর আইন ভাঙার সাহস আমাদের কোনোদিন হয়নি। সেই ষাটের দশকের একেবারে প্রথম দিকে আমার মা এবং মামা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের কাউকেই নানার সামনে কথা বলার খুব একটা সাহস করতে দেখিনি। সেই সময়কার শিতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পরিবেশ বোঝানোর জন্যই এত কথার অবতারণা করেছি। আর একটি ঘটনার কথা বলেই মূল প্রসঙ্গে ফিরব। আমি তখন ঢাকা কলেজে এইচএসসি পড়ি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বড় বোনের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গেছি। সঙ্গে অন্যান্য বন্ধুও ছিল। মা বলে দিয়েছিলেন, অবশ্যই রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু, ফিরতে এগারোটা হয়ে গেল। অপরাধটা আমার ছিল না। আমাদের সব বন্ধুকে একসঙ্গে সবার শেষে খেতে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী, বন্ধু রফিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখতে পেলাম, মা রাগে আগুন হয়ে বারান্দায় অপো করছেন। সিঁড়ি বেয়ে দু’ পা এগোতেই তিনি আমাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেলেন। দেরির কারণ ব্যাখ্যা করার আর সুযোগ মিললো না। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমার গালে সপাটে চড়। বন্ধুর সামনে মায়ের হাতে মার, ব্যথা যত না লাগলো তার চেয়ে বেশি অপমানে চোখে পানি চলে এলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বন্ধু পেছন ফিরেই দৌড়। রাগে-দুঃখে রাতে আর ঘুম এলো না। সারারাত জেগে পরিকল্পনা করলাম, ভোরের আগেই কেমন করে বাড়ি ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। এমন নিষ্ঠুর, অবিবেচক মায়ের সঙ্গে আর থাকব না। যে বন্ধুর বোনের বিয়ে খেতে গিয়ে এই বিপত্তি এবং যার সঙ্গে বাসায় ফিরেছিলাম, দুজনই পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে বোটানি এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছে। একজন দীর্ঘকাল শিকতা করে অবসর নিয়েছে। অপরজন বোধহয় এখনও বিদেশে পড়ায়। কারও সঙ্গেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। আমারও অবশ্য বাড়ি ছেড়ে পালানো হয়নি। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার সেই কঠিন মা এখনও আমার সঙ্গেই আছেন। দীর্ঘ তিন যুগ শিকতা করে অবসর নিয়েছেন, তাও এক দশক হয়ে গেল। বয়স হয়েছে, আগের সেই তেজ আর নেই। পাকিস্তানি আমলে আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। কিন্তু, অন্যের বাসায় তিনি কোনোদিন টেলিভিশন দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেননি। আজকের শাহবাগ প্রজন্মকে দেখে পুরনো সব স্মৃতি ভিড় করে আসছে। শাহবাগের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে অধিকাংশই হয়তো আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই এসেছে। আমাদের যেখানে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না, এরা কী করে শাহবাগ চত্বরে ছেলেমেয়ে মিলে সব একসঙ্গে রাতের পর রাত কাটায়, সেটা বুঝতে পারি না। নতুন প্রজন্মের এইসব তরুণ-তরুণীর পিতা-মাতার চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ কি তাহলে আমাদের পিতা-মাতার চেয়ে আলাদা? ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টি বিবেচনা না করলেও বাঙালি সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে এই আচরণ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি যুগ একেবারেই পাল্টে গেছে? এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। নিহত ব্লগার রাজীব যদি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে খুব আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, এককালের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী একবাক্যে তাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ প্রথম শহীদের সম্মান দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষায়, সে নাকি জাতীয় বীর। এই যদি ডিজিটাল তরুণের পরিণতি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এনালগ জামানাই বোধহয় অনেক ভালো ছিল। যে ছেলে ব্লগে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে এমন কুিসত বাক্য অনায়াসে লিখতে পারে, নানা প্রকার মাদকে অভ্যস্ত হয়, সংসার জীবনে অনাচার করে বেড়ায় তাকে ডিজিটাল প্রজন্ম কীভাবে নেতার আসনে বসায় সেটা আমাদের মতো প্রাচীনপন্থীরা হয়তো বুঝতে পারব না। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আধুনিক ছেলে-মেয়েদের স্বাধীনতার মাত্রার গল্প শুনে আতঙ্কবোধ করি। আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও কষ্ট করে তার অভিভাবক পিসি এবং ল্যাপটপ দুটোই তাকে কিনে দিয়েছে। সেই ছেলে পড়াশোনার অজুহাতে ঘরের দরজা বন্ধ করলে নাকি বাবা-মায়ের দরজায় টোকা দেয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই। ঝঃঁফু ঃরসব শেষ হলে তবেই নাকি তিনি দরজা খোলেন। রাজীব এবং তার সমগোত্রীয়দের অপকর্ম সম্পর্কে জানার পর থেকে আমার সেই ভাগ্নেকেও আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছি। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনলো কিনা সেটা নিয়ে ইদানীং আমি উদ্বেগ বোধ করি। কয়েকদিন আগে আমার অফিসে গল্প করার সময় অগ্রজপ্রতিম জনপ্রিয় সম্পাদক শফিক রেহমান সমাজ পরিবর্তনের একটা চমত্কার ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, ল্যাপটপ প্রযুক্তির বয়স খুব বেশি নয়। তাই যথেষ্ট পরিণত বয়সে পৌঁছেই কেবল আমরা প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। তার আগে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় নানা ধরনের বই পড়াটাই আমাদের জ্ঞানার্জন ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের েেত্র পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। তারা প্রযুক্তির সঙ্গে আগে পরিচিত হচ্ছে, তারপর পড়াশোনা। এর ফলে তাদের মননে চিরায়ত মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের বিকাশ ঘটছে না। অনেকে হয়তো শফিক ভাইয়ের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমি সেখানে চিন্তার খোরাক পেয়েছি। লেখার শুরুতেই পশ্চিমা বিশ্বে নাস্তিকের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে সেই সংখ্যা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হলেও সে সব দেশে নাস্তিকরা খ্রিস্টধর্ম কিংবা যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে ফেসবুকে ঠঁষমধত্ কোনো পোস্ট দিচ্ছে না। মৌলবাদী ইহুদি ও খ্রিস্টানদের একাংশের তীব্র ইসলাম বিদ্বেষের কারণে কখনও কখনও আমাদের ধর্ম এবং রসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে আক্রমণের নিশানা বানানো হলেও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে স্বীকার করতে হবে যে, তার অসভ্যতা অথবা ব্যাপকতা এখনও কথিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশে নাস্তিকতার আবরণে প্রকৃতপে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার সুযোগ নিয়ে একটি গোষ্ঠী ইসলামের সব প্রতীককে অনবরত আক্রমণ করে চলেছে। রাজাকারের ছবি আঁকতে গেলেই তাবত্ আওয়ামীপন্থী এবং সুশীল(?) মিডিয়ায় বীভত্স মুখ এঁকে মাথায় চাঁদ-তারা খচিত টুপি এবং থুতনিতে দাড়ি দেখানো হচ্ছে। অথচ ইসলামের আগমনকাল থেকেই চাঁদ-তারা আমাদের পূর্বপুরুষের পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দাড়ি এবং টুপি আমাদের মহানবী (সা.)’র সুন্নত। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মুখেই দাড়ি এবং মাথায় টুপি রয়েছে। অনেক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার মুখেও দাড়ি রয়েছে। নামাজ পড়ার সময় তারাও টুপি ব্যবহার করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একই ধরনের ভয়াবহ ইসলামবিরোধী পরিবেশ বিরাজ করছে। নাটক ও সিনেমায় অবলীলাক্রমে রাজাকার দেখাতে গিয়ে অহরহ মুসল্লিদের অপমান করা হচ্ছে। এ দেশের নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই ভারত-প্রেমে বুঁদ হয়ে আছেন। সেই ভারতের নাটক, সোপ অপেরা ও সিনেমায় সাধারণভাবে হিন্দু ধর্মকে মহত্ভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নাস্তিক ভারতপ্রেমীদের মতো তাদের বিখ্যাত সব মেগাস্টাররা কখনোই ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন না। শাহবাগ থেকে আমার সহকর্মী ফটোসাংবাদিক মোস্তফা এক ভয়াবহ ছবি তুলে নিয়ে এসেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, টুপি মাথায় এক তরুণ রাজাকার সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর হাস্যোজ্জ্বল এক বালিকা তার মাথায় জুতো দিয়ে পেটাচ্ছে! ছবিটা দেখে অনেকণ নির্বাক হয়ে নিজের চেয়ারে বসে থাকলাম। ধর্মের প্রতি এ কেমন ঘৃণার বীজ শিশুর কোমল মনে রোপণ করা হচ্ছে? কাদের ইশারায় হচ্ছে এসব? শাহবাগের নাস্তিকদের বিষয়ে আমার অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। এদের যত আক্রোশ কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতি কেন? বিতর্কিত ব্লগগুলোতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মকে আক্রমণ করে কোনো পোস্ট তো লেখা হচ্ছে না। আজান, নামাজ এদের চুশূল হলে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোতে এত উত্সাহ কেন? ইসলাম নিয়ে সমালোচনার ভাষাই-বা এত অশ্লীল, এত কুরুচিপূর্ণ হয় কী করে? যে সব ব্লগার এই অপকর্ম করছে, তারা কি সব মানুষরূপী শয়তান? এদের পিতা-মাতার পরিচয়ই-বা কী? সেসব পিতা-মাতা পুত্র-কন্যাদের এই বিকৃত মানসিকতা সম্পর্কে কি অবহিত? তরুণ প্রজন্মের মগজ ধোলাইয়ের কাজে কোনো বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ আছে কিনা, সেই রহস্যের উদ্ঘাটনই-বা কে করবে? ঝড়সবযিবত্ব রহ নষড়ম নামে যে ব্লগে অশ্লীল ইসলামবিরোধী প্রচারণা চলছে, তার মালিকানায় বিদেশি অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে এখনই বিশদভাবে তদন্ত করা দরকার। কিন্তু, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? কাকতালীয়ভাবে মহাজোট সরকারের মতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশে এজাতীয় চরম ইসলাম-বিদ্বেষী গোষ্ঠীর তত্পরতা শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকারের দ্বৈত বেঞ্চ অবিলম্বে ওয়েবসাইট ও ব্লগ বন্ধ এবং অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, “চবহফরহম যবধৎরহম ড়ভ ঃযব জঁষব, ঃযব ৎবংঢ়ড়হফবহঃং ধৎব যবৎবনু ফরৎবপঃবফ ঃড় ঃধশব ধষষ হবপবংংধৎু ংঃবঢ়ং ঃড় নষড়পশ ঃযব ধনড়াব হড়ঃবফ ভধপবনড়ড়শং/বিনংরঃবং/বিনঢ়ধমবং ধহফ টজখ ধহফ/ড়ৎ ধহু ড়ঃযবৎ ংরসরষধৎ রহঃবৎহবঃ ংরঃবং ধহফ ধষংড় ঃড় রহরঃরধঃব রহাবংঃরমধঃরড়হ ঃড় রফবহঃরভু ঃযব ঢ়বৎঢ়বঃৎধঃড়ৎং ড়ভ ধষষ ংঁপয ড়ভভবহংরাব বিনংরঃবং, ধঃ ড়হপব ধহফ ংঁনসরঃ ধ ৎবঢ়ড়ৎঃ ধষড়হম রিঃয পড়সঢ়ষরধহপব রিঃযরহ ২ বিবশং ভৎড়স ঃযব ফধঃব ড়ভ ৎবপবরঢ়ঃ ড়ভ ঃযরং ড়ৎফবৎ.” (রুল নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া চলাকালে, বিবাদী পকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে যে তারা যেন এই মুহূর্তে আপত্তিকর সকল ফেসবুক/ওয়েবসাইট/ওয়েব এবং ইউআরএল এবং/অথবা অন্যান্য ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এই সকল ওয়েবসাইটের হোতাদের খুঁজে বের করে। এই আদেশ প্রাপ্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্দেশ প্রতিপালন ও প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো।) আদালতের নির্দেশের পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চরম ইসলাম-বিদ্বেষী ও অশ্লীল ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ এবং তাদের হোতাদের চিহ্নিত করে শাস্তিবিধান করেনি। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে মহাজোট সরকারের সব মন্ত্রী ও এমপি অপরাধীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। শাহবাগের এক ধর্মদ্রোহী, নষ্ট তরুণ অজানা ঘাতকের হাতে নিহত হলে তাকে শহীদের খেতাব দিয়ে প্রকৃত শহীদদের অবমাননা করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সিধারীদের বাধেনি। স্বয়ং এটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের রুলের বিষয়ে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের বখে যাওয়া স্বঘোষিত নেতাকে জাতীয় বীর আখ্যা দিয়েছেন। আদালত যাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য উল্টো প্রশাসন থেকে গানম্যান দেয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল কেবল ইসলামের বিরুদ্ধেই সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করেননি, তারা একইসঙ্গে আদালতেরও অবমাননা করেছেন। কথিত শাহবাগ গণজাগরণের প্রথম থেকেই আমার দেশ এটিকে সরকারের রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত রাজনৈতিক চালরূপে বিবেচনা করছে। গত ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালীন বিচিত্র কর্মকাণ্ডে আমাদের বিশ্লেষণের সত্যতা সর্বাংশে প্রমাণিত হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া বাকি রয়েছে। কথিত গণজাগরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে ঢাকার কোন্ কোন্ বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস জড়িত ছিল এবং খাদ্য, পানীয়, ফুর্তির বিপুল অর্থায়ন কোথা থেকে হয়েছে সে তথ্যটি পাওয়া গেলেই সব রহস্যের অবসান ঘটবে। পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে তিনিই সর্বোত্তম কৌশলী। অতএব, এসব প্রশ্নের জবাবও ইনশাআল্লাহ্, একদিন মিলবে। মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করে রাজাকারবিরোধী প্রচারণার আড়ালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকৃতপে ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই ঘৃণা ছড়াচ্ছে। অথচ আজ তারাই ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের কার্যকলাপ আমার দেশ এবং আরও কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হলে তাকে ঐধঃব ঈধসঢ়ধরমহ বলে গাল-মন্দ করছেন। এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও হাতে-গোনা দুই-একটি মাত্র পত্রিকায় ইসলামের পে লেখালেখিও তারা সহ্য করতে পারছেন না। সুশীলত্বের আবরণে ঢাকা এই ফ্যাসিবাদী চিন্তা-চেতনা ক্রমেই দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। কয়েকজন তথাকথিত পেশাদার আওয়ামীপন্থী সম্পাদক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমার গ্রেফতারের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে অনবরত দেন-দরবার চালাচ্ছেন। এদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি বিশেষভাবে অবহিত আছি। এদের পেছনে যে একটি বিশেষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় রয়েছে, সে তথ্যও আমার জানা। প্রায় আড়াই মাস পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনেক অসুবিধার মধ্যে অফিসে দিনযাপন করছি। শাহবাগ চত্বর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন চিহ্নিত খুনি প্রকাশ্যে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে দেখে নেয়ার হুঙ্কার ছাড়ছেন। সরকার সমর্থক সম্পাদকদের ষড়যন্ত্রের গল্প খানিক আগেই বলেছি। এত প্রতিকূলতাও আমাদের মনোবল ভাঙতে সম হয়নি। সম্পাদকীয় নীতি হিসেবে আমার দেশ দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং ইসলামের পে অবস্থান নিয়েছে। এই পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকরা ধর্মবিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার দেশ পত্রিকার পাঠক ও দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর অভাবনীয় ভালোবাসায় আমরা ধন্য হয়েছি। সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী মতাসীন গোষ্ঠী এবং তাদের তল্পিবাহকদের নির্যাতন থেকে দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ জনগণের দোয়ার বরকতে আল্লাহই আমাদের রা করবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন