রবিবার, ২৯ মে, ২০১১

হামিদ মীর : সাহসী সাংবাদিকতার প্রতীক




হামিদ মীর। শুধু একটা নাম নয়, অকুতোভয় সাহসী সাংবাদিকতার প্রতীক। তিনি সাংবাদিক, সংবাদ উপস্থাপক, সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশেস্নষক। জন্ম পাকিসত্মানের লাহোরে ১৯৬৬ সালের ২৩ জুলাই। বড় হয়েছেন সাহিত্যিক পরিম-লে। পড়াশুনাও করেছেন সাংবাদিকতা নিয়েই। ১৯৮৯ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ (mass communication) বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন
সাংবাদিক হওয়াটা যেন নিয়তি ছিল হামিদ মীরের জন্য। কলামিস্ট বাবা অধ্যাপক ওয়ারিস মিরের আকস্মিক মৃত্যু তাকে টেনে নিয়ে আসে সাংবাদিকতার জগতে। মাত্র ২১ বছর বয়সে (১৯৮৭ সালে) যোগ দেন দৈনিক জং পত্রিকায়। সাথে ছিল বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অকুতোভয় সাহস। তৎকালীন সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের কড়া সমালোচক ছিলেন ওয়ারিস মীর। ধারণা করা হয় তার কণ্ঠ সত্মব্ধ করতে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয় তাকে। বাবার মতোই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে হামিদ মীরকেও সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। শাসকরা সমালোচনাকে ভয় পান। এই সত্য প্রমাণ করে সেনা শাসক পারভেজ মোশাররফ তো বটেই, বেনজির ভুট্টোর গণতান্ত্রিক শাসনামলেও সত্য প্রকাশের দায়ে চাকরি গেছে তার।
১৯৯৪ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে নজরে আসেন তিনি। প্রকাশ করেন ডুবো জাহাজ কেলেঙ্কারির গোপন তথ্য। ওই কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো’র স্বামী বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারির কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সরকারের রোষানলে পড়ে সংবাদটি প্রকাশের পরপরই চারকি হারান মীর। উঠে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সেইসাথে তার সাহসিকতা প্রথম পরিচয় পায় পাকিসত্মানের মানুষ।
মীর ১৯৯৬ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিসত্মানের সম্পাদক হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে পাকিসত্মানের কোনো উর্দু ভাষার দৈনিক সবচেয়ে কম বয়সী সম্পাদক হয়ে ইতিহাস গড়েন তিনি। কিন্তু তার অদম্য সাহসের পুরস্কার হিসেবে আবারও চাকরি হারালেন তিনি। অপরাধ, সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দুর্নীতি সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ।
একই বছর ১৯৯৭ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে প্রকাশ করেন দৈনিক আউসাফ। চলতে থাকে তার কলম। সেইসাথে চলে তার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। খবর প্রকাশের ÿুধায় মৃত্যু ভয়কে পরোয়া না করে চষে বেড়ান আফগানিসত্মানের পূর্বাঞ্চল। আবিস্কার করেন ২০০১ সালের ডিসেম্বরে তোরাবোরা পাহাড় থেকে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের পলানোর তথ্য। বিন লাদের যে গুহায় পালিয়ে ছিলেন তাও ঘুরে দেখেছেন এই সাহসী সাংবাদিক।
এরপর ২০০২ সালে যোগ দেন পাকিসত্মানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদভিত্তিক চ্যানেল জিও টেলিভিশনের উত্তরাঞ্চলীয় সম্পাদক হিসেবে। শুরম্ন করেন রাজনৈতিক টক শো ক্যাপিটাল টক। তুমুল জনপ্রিয় হয় অনুষ্ঠানটি। পাকিসত্মানের রাজনীতিকরা তো বটেই তার অনুষ্ঠানে এসেছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস, সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেস্নয়ার, ভারতের বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানিসহ আরো অনেকে।
মীর শুধু যে দেশের ভেতরেই হয়রানির শিকার হয়েছেন তা নয়, বিদেশের মাটিতে হয়েছেন নাজেহাল। ২০০৬ সালে ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হিজবুলস্নাহ’র হাতে গ্রেফতার হন তিনি। হিজবুলস্নাহ’র সন্দেহ ছিল-ইসরাইলের চর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় পরে তাকে ছেড়ে দেয় হিজবুলস্নাহ। পরের বছর দেশের মাটিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীর বরখাসেত্মর প্রতিবাদে আইনজীবীদের বিÿÿাভ সরাসরি সম্প্রচার করে মুশাররফ সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। নিষিদ্ধ হন চার মাসের জন্য। প্রতিবাদের রাসত্মায় নামেন তিনি। পরিণত হন আমত্মর্জাতিক ব্যক্তিত্বে। তাকে নিয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিখ্যাত সব পশ্চিমা গণমাধ্যম। ২০০৮ সালে পাকিসত্মান পিপলস পার্টিও কয়েক দিনের জন্য নিষিদ্ধ করে তাকে। মুম্বাই হামলার পর শামিত্ম ও বস্ত্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতরা মূখপাত্রে পরিণত হন তিনি।
কাজ, পুরস্কার ও স্বীকৃতি
· সেরা কলাম লেখক হিসেবে ১৯৯৬, ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে অর্জন করেন অল পাকিসত্মান নিউজ পেপারস সোসাইটি পুরস্কার।
· নারী স্বাধীনতা নিয়ে লেখার জন্য মহিলা মন্ত্রণালয় থেকে পান ফাতিমা জিন্নাহ স্বর্ণ পদক।
· ১৯৯৭ সালে তিনি দৈনিক পাকিসত্মানের জন্য ও ১৯৯৮ সালে দৈনিক আওসাফের জন্য ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
· ২০০১ সালে দৈনিক ডনের পক্ষ থেকে তিনি উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করন। এটি ছিল ৯/১১ এর পর ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে কোনো সাংবাদিকের প্রথম সাক্ষাৎকার।
· বিবিসি ও সিএনএন এই সাক্ষাৎকারটিকে আমত্মর্জাতিক বিস্ফোরণ হিসেবে আখ্যা দেয়। মাসিক হেরাল্ড ২০০১ এর ডিসেম্বরের বিশেষ সংখ্যায় এ সাক্ষাৎকারটিকে বছরের সেরা বিস্ফোরণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০০৫ সালের অক্টোবরে কাশ্মিরের ভূমিকম্পের ওপর সংবাদ সংগ্রহের জন্য মার্কিন সংবাদপত্র ‘ক্রিশ্চান সাইন্স মনিটর’ হামিদ মীরকে পাকিসত্মানি জনগণের নায়ক রূপে ঘোষণা করে।
২৬শে মার্চ ২০১০ সালে সার্কের আজীবন সম্মাননার জন্য মনোনীত হন হামিদ মীর।
সমালোচনা
তালেবানদের সমর্থক বলে মীরের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ তুলেছে অনেকে। আবার তালেবানরা সিআইয়ের এজেন্ট বলে সন্দেহ করে তাকে। তিনি পশ্চিমাদের এজেন্ডা প্রচার করেন করেন বলেও মনে করেন অনেক বিশেস্নষক। অনেকে আবার উল্টো কথাও বলেন। মার্কিন চালকবিহীন বিমান হামলা নিয়ে সদা সোচ্চার মীরকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একটু বেশিই কঠোর বলে মনে করেন তারা। আবার মীরকে ভারতের চর বলেও মনে করেন কেউ কেউ ।
সরকারের সাথে বিরোধ
তার সাংবাদিকতার জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই নানা বিষয় নিয়ে পাকিসত্মান সরকারের সাথে বিরোধে জড়িয়েছেন মীর।
· ২০০৫ সালের অক্টোবরে পাকিসত্মান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে ভূমিকম্পের খবর সংগ্রহ করতে যান তিনি। কাশ্মিরে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি আছে বলে দাবি করেন তিনি। তাকে নিষিদ্ধ করার হুমকি দেয় মুশাররফ সরকার।
· একই বছর তালেবানদের সাথে সেনাবাহিনীর তথাকথিত শামিত্ম চুক্তির বিরোধিতা করে স্বৈরশাসকের ক্রোধানলে পড়েন মীর।

· পরের বছর ২০০৬ সালে মার্কিন চালকবিহীন বিমান হামলার পর উপজাতি অধ্যুষিত বাজুর এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। প্রমাণ করেন, মার্কিন ÿÿপনাস্ত্র শুধু শিশু ও নারীদেরকেই হত্যা করে, আল-কায়েদা যোদ্ধাদের নয়।

· ২০০৭ সাল- তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে তার প্রতি অভিযোগ তোলে মুশাররফ সরকার ।





পাকিসত্মানের উত্তরাঞ্চলীয় সম্পাদক হিসেবে ২০০২ সালে যোগ দিয়েছিলেন জিও টিলিভিশনে। মাত্র ৮ বছরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন চ্যানেলটির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি এখন ব্যসত্ম বই লেখার কাজে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন